গাছতলায় ‘মুঘল-এ-আজম’এর গান রেকর্ড; গানের পুস্তিকা লিখেছেন শার্লক হোমসও!

অনেকদিন আগে একবার উস্তাদ আমির খানের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। উস্তাদজিকে জিজ্ঞেস করা হল "এত তো রাগ আছে, কোনটা গাইতে সব চেয়ে আনন্দ পান আপনি?" উস্তাদজি মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন "যতবার 'সা' টা 'সা'য়ে লাগে ততবার।" এই অদ্ভুত পারফেকশন ভালো গায়ক থেকে লেজেন্ডদের আলাদা করে এক নিমেষে।

কিংবা আবদুল করিম খাঁ সাহেবের সেই পারফরমেন্স, দর্শক এসে দেখলেন খাঁ সাহেব হাঁ করে বসে। কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। সমঝদাররা কেয়াবাত কেয়াবাত বলে কেঁদে ভাসাচ্ছে। খানিক বাদে বোঝা গেল খাঁ সাহেব পিছনের পাঁচটা তানপুরার সঙ্গে নিজের গলা এক স্কেলে মিলিয়ে দিয়েছেন। আলাদা করে আর চেনার উপায় নেই। করিম খাঁ সাহেবের মৃত্যুও অদ্ভুত। ট্রেনে করে ফিরছেন। গোধূলি লগ্ন। অচেনা এক স্টেশনে হঠাৎ থেমে গেল ট্রেন। খাঁ সাহেব ব্যস্ত হয়ে শিষ্যদের বললেন, শিগগির নেমে পড়। সময় হয়ে গেছে। স্টেশনে নেমে অজু করে নামাজ পড়ার মতো বসলেন। উদাত্ত কণ্ঠে ডুবন্ত সূর্যের সঙ্গে ধরলেন পুরিয়া ধানেশ্রী। গান শেষ হতেই লুটিয়ে পড়ল তাঁর ক্ষীণ দেহ। এই সব সঙ্গীতের মিথ। সত্যি মিথ্যে পরের কথা। কিন্তু ভাবতে ভারী ভালো লাগে।

আর একটা গল্প। বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব অনেক কষ্টে সিনেমায় গাইতে রাজি হয়েছেন। স্টুডিওতে এসে এক ফ্যাচাং। কিছুতেই মুড হচ্ছে না। শেষে নিজেই বললেন স্টুডিওতে এই বদ্ধ পরিবেশে গান হয় নাকি? চল গাছের তলায় বসে গাই। রেকর্ডিস্টের মাথায় হাত। তবু গাছ তলায় বসেই গাইলেন "শুভ দিন আয়ো।" ‘মুঘল-এ-আজম’এর এই গান করে পঁচিশ হাজার টাকা পেয়েছিলেন তিনি। অনেক নায়ক নায়িকার চেয়ে বেশি।

আবার অনেক পরে সলিল চৌধুরীর এক গানে গাইছিলেন তরুণ এক শিল্পী। কিছুতেই সুরকারের মনমতো হচ্ছে না। শেষে গায়ক বললেন আমার গলাটা বরং একটু কোমল করে গাই। সুরকারের সেটা না পসন্দ। রেগে বেরিয়ে গেলেন। গায়ক নিজের খেয়ালেই গলাকে একেবারে কোমল করে গাইলেন গানটা। শেষ হতেই দেখলেন সুরকারের চোখে জল। তিনি জড়িয়ে ধরলেন গায়ককে। তারপর থেকে সেই অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়াতন শুনে কত মানুষ কেঁদেছেন তাঁর ইয়ত্তা নেই। মান্না দে পারতেন।

আরও পড়ুন
অন্য হেমন্ত : গান-ছায়াছবির বাইরের মানুষদের চোখে

পারতেন লতাও। একবার ফুল অর্কেস্ট্রার সঙ্গে ফাইনাল টেক হচ্ছে। গান শুরু করতেই লতা থেমে গেলেন। সুরকার কে ছিলেন মনে নেই। লতার তখন বাইশ-তেইশ বছর। বললেন "সাব, কোই বেসুরা বাজা রহা হ্যায়।" প্রবীণ সুরকার ধমকে দিলেন "তুমহে জাদা পতা হ্যায়? ইস পঁচাশ মিউজিশিয়ান মে কোন বেসুরা বজায়েগা? তুম গাও।" গান শুরু করেই আবার থামলেন লতা। "মাফ কিজিয়ে সাব, ভায়োলিন মে কোই বেসুরা বজা রহা হ্যায়।" এবার একটু চমকালেন সুরকার। এত বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ধরছে কী করে? আর এই কচি মেয়ে? শেষে বললেন "তুমহি বাতাও কওন।" গান শুরু হতেই এবার লতা সোজা একজনের দিকে দেখালেন। শুধু তাঁকে বাজাতে বললেন সুরকার। অবাক কাণ্ড। সত্যিই সুর লাগছে না। সা টা সা হচ্ছে না। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন লতাকে। তুমি বিশ্বের সেরা গায়িকা হবে… ফলেওছিল সে কথা।

আরও পড়ুন
মান্না দে-র হাতে দায়িত্ব দিয়ে, মুম্বাই ছেড়ে কলকাতায় ফিরতে চেয়েছিলেন শচীন কর্তা!

একটু অন্য কথা বলি। হালকা চালের। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় একটা কার্টুন দারুণ বিখ্যাত হয়েছিল। জেনারেল নিয়াজির মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ইন্দিরা গান্ধী গান করছেন "দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার gun এর ওপারে" গান নিয়ে এত pun পুরো শিব্রামীয়। শিব্রাম অবশ্য গানের ভক্ত ছিলেন না। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে বলেছিলেন "থেমে গেলে বড্ড ভাল লাগে। আর চললে মনে হয় কালারাই পৃথিবীতে সুখী।" নারায়ণ গাঙ্গুলী নিজে গান বুঝলেও দৈত্য সঙ্গীতের মতো "ভয়াবহ" গল্প লিখেছেন। সেখানেও গানের সঙ্গে gun এর তুলনা পাই। কিন্তু ধরুন যাদের সত্যিকার gun নিয়ে কারবার, তাঁরা গানের প্রতি কতটা আসক্ত?

শার্লক হোমস প্রবলভাবে সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন। নিজে তাঁর স্ট্রাডিভেরিয়াস বেহালায় লিডার বাজাতেন। পছন্দ করতেন জার্মান উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। ‘পলিফোনিক মোটেটস অফ ল্যাসাস’ নামে সঙ্গীতপুস্তিকাও লেখেন; যা এ বিষয়ে শেষ কথা। ট্রা লা লা লিরা লে করে সুর ভাঁজতেন, কেসের মাঝে মাথার জট ছাড়াতে চলে যেতেন নর্মান নেরুলা বা সারাসাতের কনসার্টে। আমাদের ফেলুদার গানের গলাও বেশ। টপ্পা ঠুংরি পছন্দ করে। গুনগুন করে "যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী" গায়। ব্যোমকেশ এদিক থেকে নীরস। গান বাজনার ধার মাড়ায় না। ঘনাদা মৌমাছির গান শুনে অর্থ উদ্ধার করলেও নিজে গান করেন না। পরাশর বিচ্ছিরি কবিতা লিখলেও গানের পথে ঘেঁষে না। বিদেশি গোয়েন্দাদের মধ্যে হোমসের ছেলে নিরো উলফ আর ডরোথি এল সেয়ার্সের লর্ড পিটার উইমসি ছাড়া বড়ো কোনো সঙ্গীতপ্রেমীর কথা মনে পড়ছে না। রেমন্ড শ্যান্ডলারের হার্ড বয়েলড গোয়েন্দাদের অবশ্য পছন্দ ছিল chin মিউজিক। সেটা উৎপন্ন হয় চোয়ালে সপাটে মুষ্ঠাঘাত করলে। টিনটিন নিজেও gun নিয়ে অনেক দৌড়েছে। কিন্তু গান করেনি। গানের সব দায়িত্ব একাই নিয়েছিলেন বিয়াংকা কাস্তাফিয়োরে। অবশ্য সে গানও gun এর সামিল। ক্যাপ্টেন হ্যাডক অবশ্য একবার মাতাল হয়ে রকেট থেকে বেরিয়ে মহাশূন্যে কিছু গান গেয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র মানুষ যার এই কীর্তি আছে। কমিকসের কথা যখন এসেই পড়ল তখন গল গ্রামের ক্যাকোফোনিক্সের কথা না বললে চলে! কাস্তাফিয়োরের সার্থক পূর্বসুরি ইনি। অবশ্য মেঘমল্লারটা ভাল জানতেন। গান গেয়ে একবার বৃষ্টি নামিয়েছিলেন।

সুতরাং ভীষ্মলোচন থেকে ক্যাকোফোনিক্স, কাস্তাফিয়োরে থেকে রুমা ঘোষ, টেনিদার "জাগোরে নগরবাসী ভজ হনুমান" থেকে রোদ্দুর রায়ের "আমি চিনি গো চিনি"… সব গান gun মিলেমিশে এক হয়ে যাক আজকের গান দিবসে। শুধু ডিলানের একটা লাইন বড্ড মনে পড়ছে। ‘আই উইল নো মাই সং ওয়েল বিফোর আই স্টার্ট সিংগিং।’ গুপীনাথও একটাই গান জানত। একটা গানই বা সম্পূর্ণ কজন জানতে পেরেছি?

Powered by Froala Editor