মৃত্যু। শব্দটার অভিঘাত আমাদের জীবনে প্রচুর। মৃত্যুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একসময় পৌঁছে যাওয়া বৈতরণীর ঘাটে। যমের দুয়ারে। শুধু কাহিনির পাতায় নয়, বাস্তবেও মানুষ অপেক্ষা করে মৃত্যুর জন্য। একটি ঠিকানায়। সেই ঠিকানাটির অবস্থান বারাণসীতে। বারাণসী, যাকে বাঙালি 'কাশী' বলতেই বেশি পছন্দ করে। একসময় বাঙালির 'দ্বিতীয় বাড়ি'ও বলা হত কাশী তথা বারাণসীকে। বার্ধক্যে 'মুক্তি'র আশায় কতশত বাঙালি যে কাশীতে শেষ বয়সে ঠাঁই নিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এখনও কি কমেছে সেই প্রবণতা! কে জানে!
আধুনিক যুগে বারাণসীর তেমনই এক ঠিকানা 'মুক্তি ভবন'। নানা জায়গা থেকে মুমূর্ষু বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এখানে আসেন, অধীরে অপেক্ষা করেন। দিন গোনেন শেষতম মুহূর্তের।
পাঁচিল ঘেরা একটা কম্পাউন্ড। এক ঝলক দেখলে কলকাতার কোনও পুরনো বনেদি বাড়ির কথা মনে পড়বে। চমক ভাঙবে গেটের ওপরে টাঙানো সাইনবোর্ড দেখার পর। গাঢ় নীল বোর্ডে লেখা— ‘কাশী লাভ মুক্তি ভবন’। লাল রঙের দোতলা বাড়িটার ভেতর তখন সার বেঁধে অপেক্ষা করছে মৃত্যুরা। কোথাও খাটিয়াতে, কোথাও বা মেঝেতে, মাদুরের ওপর। মুক্তি ভবনের ১২টি ঘরে ঘুরলে এমনই দৃশ্য চোখে পড়বে। জানলার দিকে কেউ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। চোখে এসে পড়ছে শেষ বিকেলের আলো। হয়ত কয়েক মুহূর্ত পর তাঁরও আলো নিভে আসতে পারে। সেই অপেক্ষারই নিশ্চিত আশ্রয় এই লাল বাড়িটি।
গোটা দেশ থেকে লোকেরা এখানে আসেন মৃত্যুর সন্ধানে। বিগত ৪৪ বছর ধরে এই মানুষগুলোকে দেখে আসছেন এখানকার ম্যানেজার ভৈরব নাথ শুক্লা। যমরাজের যাতায়াত লেগেই আছে তাঁর আশ্রয়ে। তবে বারাণসীর এই মুক্তি ভবনের একটাই শর্ত। দুই সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু না হলে, ফিরে যেতে হবে। জায়গা করে দিতে হবে অন্য মৃত্যুপ্রার্থীকে।
কিন্তু যাঁদের দুই সপ্তাহ অতিক্রম করে যায়, তাঁরাও কিছুতেই ফিরে যেতে চান না। তাকাতে চান না জীবনের দিকে। যমের দুয়ারের কাঁটা পেরিয়ে সেই দিকেই যে মন রয়েছে তাঁদের। তারই তো একটা দরজা এই মুক্তি ভবন। ফিরে গেলে কী করে হবে?
Powered by Froala Editor