সম্প্রতি বিশ্বভারতী ইস্যুতে শোরগোল উঠেছে রাজ্য রাজনীতিতে। বোলপুরে পৌষ মেলার মাঠে পাঁচিল দেওয়া নিয়ে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী অবধি মন্তব্য করেছিলেন, পৌষ মেলার মাঠে কোনও নির্মাণ নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা। স্বাভাবিকভাবেই এই অনাকঙ্খিত বিতর্কের ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গায়ে যে দাগ লেগেছে, তাতে প্রশ্ন উঠছে এর বর্তমান কার্যপ্রণালী নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বহিরাগত’ উক্তির প্রেক্ষিতে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী একটি বিশেষ বার্তার মাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ‘বহিরাগত’ বলে সম্বোধন করেছেন তিনি। অভিযোগ তুলেছেন বিশ্বভারতীতে দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসা নৈরাজ্যের বিরুদ্ধেও। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের সাধের বিশ্বভারতী গড়ে তোলার পিছনে যে শিক্ষা ভাবনা কাজ করেছিল তা এখন সত্যি কতটা বেঁচে আছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং আত্মায়, তা নিয়ে একবা পিছন ফিরে দেখা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে অবশ্যই।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের বছর দুই পরে ১৮৬৩ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরভূমের ভুবনডাঙায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি ব্রহ্ম আশ্রম। ধীরে ধীরে সেটিং স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ পেতে থাকে এবং ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বরাবরই প্রাধান্য দিয়ে ছিলেন বাস্তব ও প্রাত্যহিক জীবনকেন্দ্রিক বিষয়ের উপর। শুধুমাত্র তাত্ত্বিক অথবা বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকা নয়, বরং পরিবেশ থেকে শিক্ষা লাভ করা, হাতে-কলমে কাজ শিখে কৌশলী হয়ে ওঠার মতো শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়েছিল বিশ্বভারতীতে। বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। কারণ, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষকতাকে মনে করতেন ব্রত হিসেবে; চাকরি হিসেবে নয়। ১৯০২ সালের ১২ই নভেম্বর পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর জামাতা কুঞ্জলাল ঘোষকে, যিনি শান্তিনিকেতনের প্রথম দিককার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক ছিলেন, লম্বা একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, শিক্ষাদানের যে দায়িত্ব তিনি কুঞ্জলালের উপর দিয়েছিলেন, সেটিকে কুঞ্জলাল ব্রত হিসেবে গ্রহণ করায় অত্যন্ত খুশি হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
বরাবরই তিনি দেখিয়ে এসেছেন ‘শিক্ষক’ এবং ‘গুরু’র মধ্যে বিশেষ পার্থক্যটা। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই বিশেষ ভাবনাটার গুরুত্বটা যে ঠিক কতখানি ছিল, তা অনুধাবন করা যায় খুব স্পষ্টভাবে। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে যে অরাজকতা চলছে তার দায় কি শিক্ষকেরাও বা প্রশাসকেরাও এড়িয়ে যেতে পারেন সব সময়? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘নিজের অযোগ্যতা স্মরণ করিয়া নিজেকে প্রত্যহ সাধনার পথে অগ্রসর করিতে হইবে।’ সেই প্রচেষ্টা কোথায়?
শিক্ষা এবং দেশপ্রেমের ব্যাপারটিকেও অন্য চোখ দিয়ে দেখবার চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দেশপ্রেমে অন্ধ না হয়ে গিয়ে যুক্তি দিয়ে বিচার করাকে বরাবর প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি। নিজের দেশকে অবজ্ঞা বা উপহাস না করে যেন ছাত্রছাত্রীরা স্বদেশের প্রতি বিশেষভাবে শ্রদ্ধাবান হতে পারে, সেই চেষ্টাই শিক্ষকদের করতে বলেছিলেন তিনি। অর্থাৎ অন্ধ স্বাদেশিকতার বদলে ভারতীয় সংস্কৃতির বহমান প্রাচীন ঐতিহ্যকে মানসিকভাবে ধারণ করাকেই পাখির চোখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তাঁর বিশেষ বার্তাটি হয়তো কুঞ্জলাল ঘোষকে লেখা সেই চিঠির একটি বক্তব্যেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে আরও বেশি, '...ছেলে যদি মানুষ করিতে চাই তবে ছেলেবেলা হইতেই তাহাকে মানুষ করিতে আরম্ভ করিতে হইবে, নতুবা সে ছেলেই থাকিবে, মানুষ হইবে না।’
যদিও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছে তারও অনেক আগে থেকেই। ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষাব্যবস্থায় সমালোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষা সংস্কার’ প্রবন্ধে লিও টলস্টয়ের একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলেন। তার বাংলা তর্জমার নির্যাসটুকু যদি আমরা খুঁজে নিতে চাই, তবে বর্তমান সময়ের পরিস্থিতিতেও খাপে খাপে বসিয়ে দেওয়া যায় সেটাকে: ‘যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের, তাতে মনে হচ্ছে, চুপচাপ ঠিক কাজটি ধৈর্যের সঙ্গে করে যাওয়াই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য।... ঠিক যতটা অজ্ঞ থাকবে জনসাধারণ, ততটাই শক্তিশালী হবে সরকার।... একটা ব্যাপার বড় আশ্চর্য করে আমাকে, যে মহৎ ও জ্ঞানী মানুষেরা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জীবনের বড় একটি অংশ কাটিয়ে দেন, সংগ্রামের শেষে তাঁদের প্রয়াস শেষ পর্যন্ত সরকারেরই পালে হাওয়া তুলে দেয়।'
ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির যে দিকগুলির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তা ছিল যান্ত্রিকতা, একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার লোভ এবং ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা। গতানুগতিক শিক্ষারীতির তীব্র বিরোধিতা করে তিনি লিখেছিলেন, 'ছেলেদের মানুষ করে তোলার জন্য যে যন্ত্র তৈরি হয়েছে তার নাম ইস্কুল এবং সেটার মধ্য দিয়ে মানবশিক্ষার সম্পূর্ণতা হতে পারে না।' শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠন এবং মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের মূল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় এবং মানবতা ও শিক্ষার সমন্বয়। ভাবলে অবাক লাগে, এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই আজকে এই আদর্শ থেকে ঠিক কতখানি সরে এসেছে!
বর্তমানে এমনও অভিযোগ উঠেছে যে, বিশ্বভারতী প্রাথমিকভাবে আশ্রমিকদেরই একটি বংশানুক্রমিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বয়ং উপাচার্যের কথায়, বিশ্বভারতীতে কয়েক পুরুষ ধরে বাস করা মানুষেরা বাইরে থেকে আসা কর্মী এবং আধিকারিকদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টাতেও লিপ্ত। স্বাভাবিকভাবেই এই যুক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন আশ্রমিকেরাও। কিন্তু ভাবার কথা, যে রবীন্দ্রনাথ সকলকে নিয়ে চলার কথা বলতেন, প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি থেকে আধারিত মননে যিনি তপোবন কেন্দ্রিক শিক্ষার প্রবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর দর্শনের সঙ্গে কতটা শোভনীয় এই ধরনের অভিযোগ ওঠার পরিস্থিতি?
এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন তোলাই যায়, শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত বলেই বিশ্বভারতীতে কোনরকম পরিবর্তনের কথা বলাও যাবে না, সেই ভাবনাও কি ভুল নয়? বরং যুক্তিগ্রাহ্য পরিবর্তনের কথাই তো বারবার বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু যদি সেটা হয়ে দাঁড়ায় নেহাতই ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই, দেখনদারি যদি লাগাতার গিলে নিতে থাকে আভ্যন্তরীণ আত্মার স্বরূপটিকে, তবে ভবিষ্যতের বিপত্তিকে আঁচ করে নেওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষার অভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে আধুনিক সভ্যতা। তাই সব ধরনের সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করেই বিশ্বভারতী স্থাপন তাঁর জীবনের অন্যতম মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আজকে রবীন্দ্রনাথকে সংকীর্ণতার অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে যদি আমরা তৈরি করে নিতে থাকি, তবে তার ফলে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও দর্শন যেভাবে অপমানিত হয়— তা বোধহয় কখনোই শোভনীয় নয়।
একটা পাঁচিল ভাঙার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেভাবে কলুষিত হল বিশ্বভারতীর মুখ, তা আদতেই কতটা মুখ উজ্জ্বল করবে এই প্রবাদপ্রতিম প্রতিষ্ঠানটির, সেই ব্যাপারে ভাবার সময় কিন্তু তাই এসেছে। কথা হচ্ছে, যাদের ভাবার দরকার, তারা সত্যিই ভাবছেন কি?
আরও পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধা থেকে শিক্ষাব্রতী – বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ‘বাচ্চু ভাই’ ছিলেন নিরলস
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor