হিংসার আগুনে তখন জ্বলছে গোটা পৃথিবী। মানুষ মারা যাচ্ছে লাখে লাখে। ঠিক যেন অ্যাপোক্যালিপ্স। হ্যাঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথাই হচ্ছে। সময়টাকে বিশ্বের ইতিহাসের সবথেকে অন্ধকারতম অধ্যায় বললেও ভুল হয় না খুব একটা। শুধু মৃত্যুমিছিলই নয়, বর্বর ধ্বংসলীলার সাক্ষী থেকেছিল পৃথিবী। চিত্রশিল্প থেকে শুরু করে ভাস্কর্য, স্থাপত্য— কোনো কিছুই রেহাই পায়নি নাৎসিদের (Nazi) হাত থেকে। সে-সময় একাধিক মূল্যবান শিল্পকর্মের মতোই হিটলারের সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয়েছিল ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের (Vincent Van Gogh) আঁকা একাধিক ছবি। এবার নিলামে উঠতে চলেছে বিশ্বযুদ্ধে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া তেমনই একটি ভ্যান গঘ-পেইন্টিং।
দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হলুদ ফার্ম হাউস। তাকে ঘিরে সোনালি গমের ক্ষেত। এরই মধ্যে স্তূপাকার করে রাখা আছে কাটা ফসল। আকাশজোড়া নীল মেঘ যেন আরও মায়াময় করে তুলেছে গোটা দৃশ্যকে। প্যারিসের থেকে কয়েক মাইল দূরে আর্ল শহর। ১৮৮৮ সালের জুন মাসে ছোট্ট এই প্রান্তিক শহরের গম ক্ষেতের মাঝে বসে অপরূপ এই প্রাকৃতিক দৃশ্যকে ক্যানভাসে ধরেছিলেন ভ্যান গঘ। চিত্রটির নাম দিয়েছিলেন ‘মিউলেস ডি ব্লু’। অর্থাৎ, ‘হুইটস্ট্যাকস’। তবে একটি নয়, আর্লের সেই গমের গোলার একই ধরনের দু’-দুটি ছবি এঁকেছিলেন ভ্যান গঘ। একটি ছিল জলরঙের। অন্যটি তৈলচিত্র।
অভ্যাসবশতই ছবিগুলি আঁকার পর, ভাই থিওকে সেগুলি পাঠিয়েছিলেন ভ্যান গঘ। তাঁর গ্যালারিতেই বিক্রির জন্য দীর্ঘদিন পড়েছিল ছবি দুটি। কিন্তু জীবদ্দশায় তাদের গতি দেখে যেতে পারেননি ভ্যান গঘ। থিও-ও। এর প্রায় আড়াই দশক পরে ১৯০৫ সালে থিও-র বিধবা পত্নী আমস্টারডাম শহরের একটি প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করেন ‘হুইটস্ট্যাকস’। জনসমক্ষে সেই শেষবারের জন্য প্রদর্শিত হয়েছিল ছবি দুটি। তার দু’বছরের মধ্যেই প্যারিসের সংগ্রাহক গুস্তেভ ফায়েট কিনে নেন ছবি দুটি।
১৯১৩ পুনরায় হাতবদল হয় ‘হুইটস্ট্যাকস’-এর। বার্লিনের শিল্পপতি ম্যাক্স মেইরোস্কি জলরঙে আঁকা ছবিটি কেনেন গুস্তেভের থেকে। নাগরিক হিসাবে জার্মান হলেও, ইহুদি ধর্মালম্বী ছিলেন ম্যাক্স। ফলত, বছর কুড়ি পরেই নাৎসি জার্মানির চোখে বিষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময় সেটা। নাৎসি বাহিনীর তদারকিতেই দেশ ছাড়তে হয় ম্যাক্সকে। আশ্রয় নিতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। পেট চালানোর মতো সামান্য কিছু অর্থ, জামাকাপড় ছাড়া আর কিছুই নিয়ে যেতে পারেননি ম্যাক্স। বাড়ির ধ্বংসাবশেষের মধ্যেই ছেড়ে যেতে হয়েছিল মহামূল্য সম্পদটিকে। ‘হুইটস্ট্যাকস’-এর সঙ্গে ভ্যান গঘের আঁকা নিজের একটি ছবিও রয়ে গিয়েছিল তাঁর বাড়িতে। তারপর সেই ছবির পরিণতি কী হয়েছিল, সে-ব্যাপারে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি কোনো।
আরও পড়ুন
কেন ‘আত্মহত্যা’ করেছিলেন ভ্যান গঘ? নতুন অসুস্থতার খোঁজ পেলেন গবেষকরা
অন্যদিকে ১৯৪০ সালে প্যারিস আক্রমণ করেন হিটলার। প্রায় চার বছর নাৎসি সেনাদের দখলে ছিল ফ্রান্সের রাজধানী তথা সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র প্যারিস। সেখানে সংরক্ষিত ‘হুইটস্ট্যাকস’-এর তৈলচিত্রটিরও শেষরক্ষা হয়নি। বেশ কয়েকবার হাতবদলের পর তা এসেছিল ইহুদি ব্যাঙ্কার ডে রথসচাইল্ডের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বিতীয় বছরেই তাঁর বাড়ি থেকে সেটি লুঠ করে নাৎসি সেনারা। আমস্টারডামে পালিয়ে কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচেন রথসচাইল্ড।
আরও পড়ুন
গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে, শেষ ছবিটি কোথায় এঁকেছিলেন ভ্যান গঘ? অবশেষে মিলল হদিশ
জার্মান অধিকৃত অস্ট্রিয়ার স্ক্লস কল দুর্গে সংরক্ষিত ছিল তৈলচিত্রটি। কিন্তু জলরঙে আঁকা ছবিটির আর হদিশ মেলেনি বিশ্বযুদ্ধের পরেও। এর প্রায় তিন দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর ১৯৭৮ সালে অবৈধ পথে নিউইয়র্কের ওইল্ডেনস্টাইন গ্যালারিতে এসে পৌঁছায় ছবিটি। বছর খানেকের মধ্যে তার মালিকানা দখল করেন এডউইন কক্স নামের এক ইহুদি ব্যক্তি। এতদিন তাঁর পরিবারে থাকার পর, এবার নিলামে উঠতে চলেছে ‘হুইটস্ট্যাকস ওয়াটকালার’।
আরও পড়ুন
আত্মহত্যা করেননি ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ; হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে!
ছবিটির আনুমানিক দাম হতে চলেছে ২ থেকে ৩ কোটি মার্কিন ডলার। এমনটাই ধারণা চিত্র গবেষক ও ব্যবসায়ীদের। তবে মার্কিন মুলুকের ক্রিস্টিস গ্যালারি ছবিটির নিলামে ওঠা নিশ্চিত করলেও, রয়ে গেছে বেশ কিছু ধোঁয়াশা। ইতিমধ্যেই ছবিটির পূর্ববর্তী মালিক রথসচাইল্ড এবং ম্যাক্সের উত্তরসূরিরা বিক্রয়মূল্যের ওপর অংশীদারি দাবি করেছেন। কিন্তু সে-ব্যাপারে তাঁদের এখনও কোনো চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করায়নি ক্রিস্টিস। অভিযোগ এমনটাই। তবে যা-ই হোক না কেন, ঐতিহাসিক এই ছবিকে বাগে পেতে ফ্রান্স কিংবা নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী মিউজিয়ামগুলি সর্বশক্তি দিয়ে নিলামে ঝাঁপায় কিনা, সে-দিকেই চোখ এখন সকলের।
Powered by Froala Editor