ওয়াজিদ আলী শাহ-র বংশধরের হাতেই মুক্তি 'মুঘল হারেম'-এর, সঙ্গী অন্দরমহলের কিসসা

‘অঙ্গন তো পর্বত ভয়ো ঔর দেহরি ভয়ী বিদেশ
জায়ে বাবুল ঘর আপনো মে চলি পিয়া কে দেশ’

১৮৫৬ সালের ১৩ মে। গঙ্গার ঘাটে ভিড়ল জেনারেল ম্যাকলিওড স্টিমার। ডেকে দাঁড়িয়ে এক বিষণ্ণ নবাব। ওয়াজিদ আলী শাহ। মাসখানেক আগেই মাথার তাজ সঁপে দিয়েছেন জেমস আউটরামকে। এখন তাঁর আস্তানা মেটেবুরুজ বা গার্ডেনরিচ। এখানেই জীবনের ৩১টি বছর কাটাবেন লখনৌর শেষ নবাব। তবে নবাব তাঁর এই নির্বাসনে একা ছিলেন না। সঙ্গে এসেছিলেন অসংখ্য বেগম, পরিচারক, রাঁধুনী, আত্মীয়, পারিষদ, দোস্ত। প্রায় ৬০০০ প্রজা, ইমামবারা, প্রাসাদ, চিড়িয়াখানা নিয়ে মেটিয়াবুরুজ হয়ে ওঠে কলকাতার ছোটো লখনৌ। ব্রিটিশ আইন খাটে না সেখানে। সন্ধ্যায় নবাবের প্রাসাদ থেকে ভেসে আসে ঠুমরির সুর। রাত বাড়লেই শোনা যায় ঘুঙুরের শব্দ। শৌখিন নবাব তাঁর একলক্ষ টাকা মাসোহারা অবলীলায় উড়িয়ে দেন প্রিয় কবুতরের মতো। তোষাখানার টানাটানি এড়াতে পারস্যের বিরিয়ানিতে ঠাঁই হয় পর্তুগালের আলুর।

গতকাল, ২৬ নভেম্বর, নিউটাউনে ‘কারু এক্সপিরিয়েন্স সেন্টারে’ প্রকাশিত হল শ্রীমতী ভামা গৌরের (Vama Gaur) দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মুঘল হারেম’ (The Mughal Harem) আর সেখানেই ইতিহাসের পাকদণ্ডি বেয়ে শ্রোতারা পৌঁছে গেলেন কয়েকশো বছর আগে। গল্পের জাল বুনছিলেন ওয়াজিদ আলী শাহ’র বংশধর জনাব শাহেনশাহ মির্জা। লেখিকা নিজে ইতিহাসের ছাত্রী নন। কিন্তু মুঘল অন্দরমহল নিয়ে তাঁর নিবিড় চর্চা প্রশংসার দাবি রাখে। বেগম জাহানারার এক বাঁদি ফেরদৌসের বয়ানে ফুটে উঠেছে মুঘল হারেমের আলো আঁধারির ফাঁকে চলতে থাকা নিরন্তর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। যেখানে সম্রাট শাহজাহান, বেগম জাহানারা বন্দি হচ্ছেন ঔরঙ্গজেবের হাতে। ঘাতকের তরবারির কোপে লুটিয়ে পড়ে জেষ্ঠপুত্র দারার মাথা।

জাহানারার বন্দিজীবনের যন্ত্রণা কোথাও মেশে ওয়াজিদ আলী শাহের দীর্ঘশ্বাসে। বৃদ্ধ শাহজাহানের এন্তেকালের পর তাঁকে মুক্তি দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেব। জাহানারা ফিরে এসেছিলেন মুঘল অন্তঃপুরে। মুঘল রাজনীতিতে নিজের আসন পুনর্দখল করতে তাঁর বেশি বিলম্ব হয়নি। অপরদিকে ব্রিটিশ শাসকের বদান্যতায় ৬৫ বছরের বৃদ্ধ ওয়াজিদ আলী শাহ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, নিজের হাতে গড়া নকল জন্নতে। লখনৌ ছেড়ে আসার পর নির্বাসিত নবাব লিখছেন, “একটা সময় ছিল, যখন আমার পায়ের তলায় থোকা থোকা মুক্তো চাপা পড়ত। এখন শুধু ওপর থেকে এক নিষ্ঠুর রোদ আর পায়ের তলায় কাঁকর”। ইতিহাসের আনাচে কানাচে উঁকি মারলে, এই দুই চরিত্রের মধ্যে আশ্চর্য মিল পাওয়া যায়। দু'জনেই ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামির পরিপন্থী। জাহানারা আঁকড়ে ধরেছিলেন সুফিদর্শন। ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে শরিয়তি শাসন নিয়ে প্রায়শই সংঘাত বাধত তাঁর। আর ওয়াজিদ আলি, তাঁর ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে লিখেছিলেন নাটক বা রহস ‘রাধা-কানহাইয়া কা কিসসা’। এটিকেই প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক বলা হয়ে থাকে। রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে এটি ছিল একটি নৃত্যনাট্য। শোনা যায় মেটিয়াবুরুজে আরো পরিণত আকারে একাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘রাধা-কানহাইয়া কা কিসসা’। ভামার কলম ডুব দেয় ইতিহাসের অন্তরালে। পাশে থাকেন, জনাব মির্জা।

বই-এর কিছু অংশ পাঠের পর পাঠকদের জন্য ছিল মুঘল ইতিহাস নিয়ে একটি মজার কুইজ। স্বল্প চা-জলযোগের ফাঁকে ফাঁকে শ্রোতা-দর্শকের চোখ চলে যাচ্ছিল কারু এক্সপেরিয়েন্স সেন্টারে রাখা অপূর্ব শিল্পকর্মগুলির উপর। কলকাতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে নিউটাউন। আর তারই একপ্রান্তে কারু এক্সপেরিয়েন্স সেন্টার। যেখানে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের শিল্পকলা জড়ো হয়েছে এই অভিনব আর্টহাউজের ছাতার তলায়। কাগুজে লণ্ঠনের আলোয় প্রস্তরের বুদ্ধমূর্তির অনতিদূরেই মুঘল মিনিয়েচর, শ্রোতা-দর্শকদের কাছে হাজির করেছিল এক অনবদ্য পরিবেশ। এই অপূর্ব সন্ধ্যাকে সার্থক করে তোলার পেছনে ‘কারু’র অবদান বড় কম নয়।

Powered by Froala Editor