মে মাসের ঠা ঠা রোদের শান্ত একটা দুপুর। সিগন্যালিং টাওয়ার, ডিশ অ্যান্টেনা, কখনও বা লাইটস-রোলিং-ক্যামেরার এক নেপথ্য জগত। কলকাতার এক এলিট-সবুজ পাড়ার সুবিশাল ভবনটির প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ না থাকলেও কৌতূহল ছিলই। সঙ্গে আটপৌরে ঘরানার প্রতি এক টান। আমি গিয়েছিলাম তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য লেখার কাজের ব্যাপারে কথা বলতে। দূরদর্শন ভবনে সেদিনই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। সরাসরি নয়, পরোক্ষে। মাসদুয়েক আগেই দূরদর্শনের পক্ষ থেকে ‘বৈদ্যনাথের ইতিকথা’ নির্মিত হয়েছে। নির্মাতা অনিন্দ্য রায়ের মুখে শুনছিলাম তাঁর কথা।
একসময়ের নিষ্ঠাবান চিত্রগ্রাহক, নামকরা প্রোডাকশনের ব্যানারে থাকত যাঁর নাম, সেখান থেকে নব্বই-উত্তীর্ণ বয়সে এসে খিদের আশ্রয়ের একমাত্র ভরসা রামকৃষ্ণ মিশনের দরিদ্রসেবা, এসব নিয়ে গত দু-এক বছরে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে চর্চা হয়েছিল ভালই। বলা যায়, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বিস্মৃতির ফাঁকে সামান্য পরিচিতি-লাভ। বৈদ্যনাথ বসাক তো নেহাতই এক উদাহরণ। ডিজিট্যাল যুগের আস্ফালন যে তাঁর মতো আরও কত শিল্পীকে কর্মহীন করে দিয়েছে, তার কোনো তালিকা এখনও প্রস্তুত হয়নি।
সুবিশাল ফিল্ম ক্যামেরাকে চালনা করার প্রতিকূলতা, উন্নত মানের ফিল্ম পাওয়ার সীমাবদ্ধতা নিয়েই সেইসময়ে বাজিমাত করেছেন অজয় কর, রামানন্দ সেনগুপ্ত, বিভূতি লাহা, দীনেন গুপ্ত, সুব্রত মিত্র, সৌম্যেন্দু রায়রা। যান্ত্রিক দিক থেকে বিশেষ সুবিধা না পাওয়ার বিষয়টি বরং তাঁদের সাহায্য করেছিল নিজ-কল্পনা শক্তিকে ভরপুর উদ্ভাবনের কাজে। তাই সেই কাজে তাঁদের পরিশ্রম হত ঠিকই, কিন্তু সেখানে স্বাধীন সৃষ্টির আনন্দ ছিল। সৌম্যেন্দু রায় নিজেই আমায় বহুবার বলেছেন – ‘যন্ত্র এখন নিয়ন্ত্রণ করছে যন্ত্রীকে।’ যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় অপারগ মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তব হল এটাই, অটোমেটিকের যুগে স্ব-উদ্ভাবনের স্পেস যে অনেক কমে এসেছে, একথা শিল্পীরা কমবেশি স্বীকার করবেনই। বৈদ্যনাথ বসাকের যে দারিদ্র্য নিয়ে বিগত দু’বছরে খানিক চর্চা হয়েছিল, তাঁর সেই দুরবস্থা আংশিকভাবে সেই পরিবর্তনেরই ট্র্যাজেডি।
বৈদ্যনাথ বসাককে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু কী এক অদ্ভুত যোগাযোগ ঘটেছিল ওই বাইশ মিনিটের পর্দা-চারণায়। বর্ণময় জীবনের কথা বলতে গিয়ে অমলিন মুখের হাস্যোজ্জ্বলতায় ভরে উঠবে দর্শকের মন। তরুণ বয়সের সুপুরুষ চেহারার পারিপাট্য পুরোপুরি কেড়ে নিতে পারেনি বার্ধক্য-জরা। ‘বুট পলিশ’ ছবিতে চিত্রগ্রাহক তারা দত্তকে অ্যাসিস্ট করেছিলেন তিনি। কাজের মুন্সিয়ানা দেখে রাজ কাপুর ‘শ্রী ৪২০’-এও তাঁকে চেয়েছিলেন ভীষণভাবে। কিন্তু বাঙালির স্বভাবগত গৃহ-আকর্ষণ এমন সুবর্ণ সুযোগকেও দিব্যি উপেক্ষা করিয়ে তাঁকে এনে ফেলল টালিগঞ্জের চরিত্রগত অনিশ্চয়তায়। বড়ো প্রোডাকশনে বহু কাজ করেছিলেন তিনি, কিন্তু মাসিক মাইনে হিসেবে তিরিশ টাকা নির্বিবাদে ঢুকিয়ে নিতেন যে মানুষটি, কেবলমাত্র ভাত-ডালের সংস্থানটুকুর নিশ্চয়তা পেয়ে, তাঁর কাছে বুঝি এই চরম অপেশাদারিত্বও কখনও কাজের কাছে বাধা হয়নি। আর কী অদ্ভুত সমাপতন, ঠিক এই বর্তমান সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার আরোপিত পরিকল্পনাহীন লকডাউনের কারণেও চলচ্চিত্রের অসংগঠিত ক্ষেত্রটি যখন প্রবলভাবে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে, সামান্য দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে জীবনধারণ করা অগণিত টেকনিসিয়ানের ভাগ্য ঝুলছে পেন্ডুলামের সুতোয়, ঠিক সেই সময়েই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন মানুষটি।
আরও পড়ুন
কবর থেকে কঙ্কাল তুলে পরানো হয় নতুন পোশাক, নেওয়া হয় ফ্যামিলি ফটোগ্রাফও!
খারাপ শুনতে লাগলেও একথা সত্যি, যে স্টুডিওপাড়া থেকে বিশ্বমানের শিল্পশৈলীর জন্ম হয়েছে, সেটি কোনোদিনই পেশাদার শিল্পক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারেনি। প্রযোজক, পরিবেশক কিংবা প্রেক্ষাগৃহ-মালিকদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার পরিসংখ্যান ঘুরে ফেরে এর আনাচে কানাচে। তুলসী চক্রবর্তী কিংবা মণি শ্রীমানীরা আজীবন নিজেদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, পাহাড়ী সান্যালের মতো বিদেশি ভাষা-জ্ঞানী গায়ক-অভিনেতাকেও শেষ জীবনে লড়তে হয়েছিল দারিদ্র্যের সঙ্গে। তাঁদের মতো প্রথম সারির অভিনেতাদেরই যেখানে এহেন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেখানে ক্যামেরার পিছনের মানুষ হয়ে স্বভাব-বিনয়ী বৈদ্যনাথের জীবনেও যে একই পরিণতি নেমে এল, তা থেকে অন্তত এটুকু পরিষ্কার যে, টালিগঞ্জের ট্র্যাডিশন আসলে কখনোই বদলায়নি। ঠিক সেই কারণেই, রাজ কাপুরের এই অনুরোধকে প্রত্যাখ্যান করে চলে আসার মধ্যে ‘বাঙালি নিজের ভালো বোঝে না’, এই নেগেটিভ ধারণাই যেন আরও বেশি করে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে এর চর্চিত চর্বণের বাইরেও তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের নানাবিধ অভিজ্ঞতাই হয়তো তাঁকে শেষদিন অবধি ভরিয়ে রেখেছিল। ভারত যেবছর স্বাধীন হয়, সেই বছরেই বিভূতি লাহার কাছে ক্যামেরার কাজ শিখতে এসেছিলেন তিনি। ‘অগ্রদূত’ ততদিনে তৈরি হয়ে গেছে। তাঁদেরই পরিচালনায় ১৯৫১ সালে মুক্তি পেল ‘বাবলা’, প্রথমে বাংলা ও পরে হিন্দিতে। এক প্রেস-কম্পোজিটরের জীবন নিয়ে ছবি। কলকাতার রাস্তায় তাঁর দুর্ঘটনা, ফলত ভরণপোষণের জন্য স্ত্রীর অতিরিক্ত কাজ এবং নাবালক ছেলে বাবলার স্কুল ছেড়ে সংবাদপত্রের ফেরি করে বেড়ানো, তার সততা, সব মিলিয়ে তখনকার ধারা অনুযায়ী একটি সফল ফ্যামিলি মেলোড্রামা। ছবিটি ১৯৫২ সালের প্রথম ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চারটি ভারতীয় ছবির মধ্যে জায়গা পায় তো বটেই, সঙ্গে সেই বছরেই মধ্য ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ চলচ্চিত্র উৎসব, চেকোস্লোভাকিয়ায় আয়োজিত সপ্তম কার্লোভি ভ্যারি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ সামাজিক প্রগতি-মূলক ছবি হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয়। অর্থাৎ, বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার পাওয়া প্রথম বাংলা ছবির নামটি হল ‘বাবলা’। বৈদ্যনাথ বসাক ছিলেন সহকারী চিত্রগ্রাহক হিসেবে। শেষ বয়সের নিভে আসা স্মৃতি থেকে তিনি বলতেন, অগ্রদূতে তাঁর যোগদান বোম্বে থেকে আসার পরে, মিড ফিফটিজে। বাংলা ছবির এমন গৌরবময় আখ্যানটির সঙ্গে তাঁর জড়িয়ে থাকার ঘটনাটি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, কিন্তু এ ইতিহাসকে আমরা ভুলি কীভাবে!
আরও পড়ুন
মাস্কে ছাপা মানুষের মুখের ছবি, অভিনব উদ্যোগ কেরালার ডিজিট্যাল ফটোগ্রাফারের
উত্তমকুমারের সঙ্গে বাহাত্তরটি ছবিতে কাজ, পরিচিত জনদের মুখে শুনেছি, বারবার ঘুরেফিরে বলতেন সেসব কথা। নাম মনে করতে পারতেন না, কিন্তু বিশেষ মুহূর্তগুলি ঝিলিক দিয়ে যেত দিব্যি। ‘বাদশা’ ছবির কথা অবশ্য ভোলেননি। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব, দুই না-মানুষী অভিনেতা বাঁদর আর কুকুরের তীক্ষ্ণ অভিনয়-জ্ঞানে মোহিত হয়ে যাওয়া, এসবই ছিল তাঁর ব্যক্তিগত দিনক্ষয়ের সঙ্গী। শুট করতে নেমেছিলেন রাজস্থানের ৭০০০ ফুট গভীর তামার খনিতেও। তাঁর সহকারী অজ্ঞান হয়ে গেলেও সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তিনি তুলে এনেছিলেন খনির ভয়াবহতাকে, মানুষের ব্যবহারিক ধ্বংসলীলাকে। আবার খুব সামান্য হলেও সেই ঝাপসা স্মৃতির মধ্যে রয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। একটি ছবিতে একদিন অ্যাসিস্ট্যান্ট টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছিলেন। কোন ছবি, মনে করতে পারতেন না আর। কিন্তু, ওই একদিনেই মানিকবাবুর ‘আউটডোর লাক’-এর দুর্লভ সাক্ষী হয়েছিলেন তিনিও।
নেপালের রাজপরিবারের পেশাদার আলোকচিত্রীর কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। রাজা মহেন্দ্রর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে তুলতেন তাঁর ছবি। সেই কাজ করতে গিয়েই একদিন তাঁর চোখের সামনেই রাজার গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। নেপালের দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অস্থিরতার রক্তাক্ত ইতিহাসকে চোখের সামনে দেখেছিলেন তিনি। রাজার কর্মচারী হিসেবে একজন উগ্রপন্থীকে তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেই ধরে ফেলেছিলেন। পরে সেই লোকটির ফাঁসি হয়ে যায়। মিলিটারি জেনারেলের সন্দেহ ছিল তাঁর দিকেও। সব জেনেশুনে আর নেপালে থাকেননি তিনি। একরকম মিথ্যে কথা বলেই ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। কিছুদিন পরেই স্ত্রী-বিয়োগের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাঁকে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চিত জীবন বোধহয় কখনোই তাঁর জন্য লেখা হয়নি।
আরও পড়ুন
১৩৬ বছর আগে তোলা এই ছবিই ঘুর্ণিঝড়ের সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফ
জীবনের ইতিকথা বলতে বলতে অন্তিম পর্যায়ের ক্লোজ-আপে এসে ধরা দেয় তাঁর সদাহাস্য, অনুযোগহীন মুখ। মধ্য নব্বইতে এসেও কী সতেজ আত্মবিশ্বাসে বলে উঠছেন – ‘আমি লাইটিং-ফাইটিংগুলো করে দিতে পারব বা সেখানে থাকতে পারব, তোমায় আমি আনন্দ দিতে পারব।’ শেষ তিনটি কথা বলতে গিয়ে কেঁপে যাওয়া গলা, কর্মসন্ধানী মানুষের কর্মপিপাসার আন্তরিক আকুতি, মনোযোগী দর্শকের চোখের কোল ভিজিয়ে তুলবে নিঃসন্দেহে। শিল্পী যে আসলে কখনোই দরিদ্র হননি।
ঋণ স্বীকার:
আরও পড়ুন
'ইয়ে হ্যায় বম্বে মেরি জান' - অরিজিৎ পাইনের ফটোগ্রাফি
‘বৈদ্যনাথের ইতিকথা’ – একটি কলকাতা দূরদর্শন নিবেদন
Rajadhyaksha, A. ‘Partition and the all-India film.’ Indian Cinema: A Very Short Introduction, 1st edition, Oxford University Press, 2016.
আরও পড়ুন
তাঁকে জড়িয়ে শুয়ে আছে চিতা, ঘুম থেকে উঠে দেখলেন ফটোগ্রাফার
Rajadhyaksha, A and Willemen, P. ‘Films’. Encyclopedia of Indian Cinema, p. 1994, 2nd edition, Routledge, 2012.
দোলন ঘোষ
আরও পড়ুন
কালীপটকার উল্লাস নয়, দীপাবলির দিন সারমেয়-পূজা হয় নেপালে
শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
তরুণ বৈদ্যনাথ বসাকের ছবি সৌজন্যে অনিন্দ্য রায়, ছবিটি রাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগ্রহ
আরও পড়ুন
পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা পরাভূত - ভারত ফের উপমহাদেশের 'সেরা'
Powered by Froala Editor