“আজ এতদিন পর এসে মনে হল, হ্যাঁ করোনা পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষরাও সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেই বোধদয়ও যেন আদালতের কাগজেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন অন্তত আমি দেখতে পাচ্ছি না।” প্রহরকে এমনটাই জানাচ্ছিলেন দৃষ্টিহীন শিক্ষক সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত সোমবার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়ে উঠে এসেছে দৃষ্টিহীন এবং ব্যবহারিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সুযোগসুবিধার বিষয়টি। বিচারপতি সঞ্জীব ব্যানার্জির বেঞ্চ সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন, কোভিড ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য কী কী বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তামিলনাড়ু সরকার জানিয়েছে, তাঁরা ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামে ইতিমধ্যে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জন্য আলাদা সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে সেই উদ্যোগ কতটা কার্যকর, এবং দেশের অন্যান্য প্রান্তে এই সুযোগ কতটা পাওয়া যাবে, তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে।
অন্যদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিহীন গবেষক শ্রেয়া ঘোষ বলছেন, “শুধুই প্রতিষেধক নিতে গিয়ে আমাদের সমস্যা হবে, এমনটা তো নয়। করোনা পরিস্থিতিতে বারবার সমস্যায় পড়তে হয়েছে আমাদের।” গত আগস্ট মাসে কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন শ্রেয়া। সেই অভিজ্ঞতার কথাও জানালেন তিনি। “করোনা সংক্রমণ রুখতে গেলে শারীরিক দূরত্ব রাখতে তো হবেই। কিন্তু আমরা যারা চোখে দেখতে পাই না, তাঁদের জন্য হয় আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে কারোর সাহায্য ছাড়া তো আমাদের পক্ষে দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো করাও সম্ভব হবে না। অথচ হাসপাতালে তেমন কোনো ব্যবস্থাই চোখে পড়েনি।” এমনকি তিনি জানালেন, “তার কিছুদিন আগে আমার মা কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাবা তখন কোভিডের কারণেই হাসপাতালে ভর্তি। ফলে আমাকে একাই সমস্ত ব্যবস্থা করতে হয়। অথচ কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি। এমনকি হাসপাতালে ভর্তির জন্যও এসকর্ট সার্ভিস পেয়েছিলাম, তা কেবল আমার নিজস্ব জানাশোনা ছিল বলেই। কিন্তু আমার মতো বহু মানুষের জন্য এমন কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।”
সায়ন্তনের কথায়, “এখন এই নির্বাচনের সময় নানারকম জনহিতকর কথা শোনা যাচ্ছে। আমাদের সুযোগ সুবিধা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এতদিন আমাদের সমস্যার খবর রাখেননি কেউই।” আজও এইসব আলোচনা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে বলে মনে করছেন না তাঁরা। সায়ন্তন জানালেন, “কোউইন অ্যাপটি ব্যবহার করতে গিয়ে দেখি তা দৃষ্টিহীন মানুষদের ব্যবহারের উপযোগী নয়। তাছাড়া যাঁরা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না, তাঁদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য সরকারি অফিসে কোনো ব্রেইল ফর্মের ব্যবস্থা করা হয়নি।” এই সামগ্রিক জটিলতার মধ্যেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ন্যাশানাল ফেডারেশন অফ ব্লাইন্ড। সেই জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রের সচিবালয় জানিয়েছে, ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সমগ্র কোভিড চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে আরপিডব্লিউডি আইনের প্রতিটি ধারা মাথায় রাখতে হবে। বিশেষ করে দৃষ্টিহীন এবং ব্যবহারিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষরা এই এক বছরে বারবার বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, একথা কার্যত মেনেই নিয়েছে সচিবালয়।
আরও পড়ুন
হেল্পডেস্ক তৈরি করলেন কোভিড-আক্রান্ত নাট্যশিল্পীরাই
“তাহলে একথাও মেনে নিতে হয়, এই এক বছর ধরে আরপিডব্লিউডি আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। আজ আমাদের প্রতিনিধিরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন বলেই সুবিচার পাচ্ছি। তাহলে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে কি আমাদের এভাবে লড়াই করেই অধিকার আদায় করতে হবে?” – প্রশ্ন সায়ন্তনের। মহামারী পরিস্থিতিতে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। আর তার মধ্যেই বিভিন্ন নির্বাচিত সরকার একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত। সাধারণ মানুষের সুযোগ-সুবিধার দিকটি কার্যত উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের বিতর্কের মধ্যে। আর যাঁরা সামগ্রিকভাবে আরও বেশি বৈষম্যের শিকার, তাঁদের কথা কি এতদিন ভুলেই গিয়েছিলেন জনপ্রতিনিধিরা? উঠছে এমন সব প্রশ্নও। তবে মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে হলেও এতদিন পর যদি তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে হয়তো আর নতুন করে বৈষম্যের মুখে পড়তে হবে না প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের।
আরও পড়ুন
‘আমরা খেতে পেলে কোভিড-আক্রান্তরাও খেতে পাবেন’; লড়ছে বাঙালির রান্নাঘরও
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কোভিড-মোকাবিলায় ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার, যোগাযোগ বুনছে বাংলার তরুণ প্রজন্ম