‘আল্পস, এখানে? কেমন আছ?’ প্রশ্নটা ধেয়ে আসতেই স্টুডিয়ো পাড়ায় আলো চিকচিক করে ওঠে। কে কাকে এমন প্রশ্ন করলেন, তা ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে সেদিন সিনেমাপাড়ায় অপ্রত্যাশিতই দেখা হয়েছিল চাঁদের সঙ্গে চাঁদের।
সিনেমাপাড়ায় একটি গাড়ি এসে থামে। সৌম্যদর্শন এক পুরুষ নামলেন। দেখতে পেলেন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তাঁরই পরিচিত এক শিল্পী। এগিয়ে গেলেন। তার পারেই ‘আল্পস’কে প্রশ্নটি করেই ফেললেন। ঘটনাচক্রে সেই শিল্পী পেশায় এক গায়িকা। গায়িকা জানালেন, তিনি গানের জন্যই এসেছেন টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ায়। সুতনু সেই পুরুষ বললেন, ‘ভাবছি একটা সিনেমা করব। তাতে তুমি আমার নায়িকা হবে। আবার গানও গাইবে।’ এমন ‘আবদার’ শুনে তো লজ্জায় লালচে গায়িকা। ‘না দাদা, আমি সিনেমা করলে ডাহা ফ্লপ করবে। ওটা বরং তুমিই করো। আমি বরং গানটাই গাই।’ একটা গোটা দশক যিনি গানের জগতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, যাঁর গান রেডিয়োর অনুরোধের আসরে বারবার শোনাতে হত, চোদ্দ বছর আগে অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন। সেদিনের সেই সৌম্যকান্তি পুরুষ উত্তমকুমার (Uttamkumar)। আর মহানায়কের সেদিনের ‘আল্পস’ হলেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় (Alpana Bandyopadhyay)।
মহানায়কের নায়িকা কখনও হননি বটে, তবে সংগীত জগতে ‘নায়িকা’ হয়ে উঠেছিলেন। বলা ভালো, উত্তমের নায়িকার গানের স্বর হয়ে তিনি গেয়েছিলেন ‘আজ আছি কাল কোথায়’, সেই ১৯৫৪-তে অগ্রদূত পরিচালিত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমায়। সংগীত পরিচালক ছিলেন অনুপম ঘটক। উত্তম-সুচিত্রা মানেই তখন হিট। বাঙালি রীতিমতো অপেক্ষা করে থাকত এই জুটিকে বড় পর্দায় দেখতে পাওয়ার আশায়। এমনই কোনও আবহে ১৯৫৬ সালে মুক্তি পেল চিরকালীন সুপারহিট জুটির ‘সাগরিকা’। অগ্রদূত পরিচালিত এই ছবিতে প্রণব রায় এবং রবীন চ্যাটার্জির যুগলবন্দিতে প্লেব্যাক গেয়েছিলেন আলপনা। ‘হৃদয় আমার সুন্দর তব পাই/ বকুলের মতো ঝড়িয়া মরিতে চাই’— আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গানটি মনের আরাম। এর ঠিক একবছর পর ১৯৫৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল বিখ্যাত ছবি ‘পথে হল দেরি’। পরিচালক সেই অগ্রদূত। আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সিনেমায় গেয়েছিলেন ‘কাকলি কূজনে’। মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন রবীন চ্যাটার্জি। আর হ্যাঁ, লিপ মেলালেন স্বপ্নের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। ’৫৭-তে মুক্তি পেয়েছিল নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত ‘পৃথিবী আমাকে চায়’। এই সিনেমায় শ্যামল মিত্রের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন আলপনা। গানটি ছিল ‘কেউ নয় সাহেববিবি’। গানটি লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সংগীত পরিচালক ছিলেন নচিকেতা ঘোষ। গানে গানে যেন আলপনা এঁকে দেয় এসব সম্পদ।
এক সাক্ষাৎকারে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এত নাম... প্রশংসা... পুজোর হিট গান ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে ভালো লাগল?’ স্মিত হেসে আলপনা বিকেলের সেই মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘খুব জেদ করে এসেছিলাম জানেন... আর একদিন হেলাফেলায় সব ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম... না কোনও রাগ... অভিমান নিয়ে নয়... এমনি...। লোকচক্ষুর আড়ালে এলাম... কিন্তু গানকে ছাড়লাম না... গানও আমায় ছাড়েনি...।’ ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর বাবা কান্তিগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বড় হয়েছিলেন তিনি। গান শেখাও বাবার কাছে। বাবা ছিলেন প্রেসেডেন্সি কলেজের বোটানির প্রফেসর এবং ডিপার্টমেন্টাল হেডও। অধ্যাপনা ছাড়াও নিয়মিত গানের চর্চা করতেন। তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ বাদল খাঁ-র কাছে। ওস্তাদের কাছেই শিখেছিলেন ধ্রুপদি সংগীত। তবে মানুষটি ছিলেন প্রচারবিমুখ। বাড়িতে বিনা পারিশ্রমিকে ছাত্রছাত্রীকে সংগীত শিক্ষা দিতেন কান্তিগোপাল। ছোট্ট আলপনা যা শুনতেন, তা-ই গলায় তুলে নিতেন হুবহু। একদিন মাথার বালিশকে হারমোনিয়াম বানিয়ে আপন মনে বাবারই গান গাইছিলেন ছোট্ট আলপনা। মেয়ের গান শুনে অবাক হলেন কান্তিগোপাল। আসলে তখনই বুঝেছিলেন যে, তাঁর মেয়ের ‘হবেই হবে’। যেমন বোঝা তেমনই কাজ। পরের দিন থেকে বসে পড়েন মেয়েকে গান শেখাতে। এরপর বাকিটা ইতিহাস। খুব বেশিদিন গানের জগতে থাকেননি আলপনা। যেক’টা দিন ছিলেন মন মাতিয়ে গেছেন।
কেন তিনি এভাবে সব ছেড়েছুড়ে চলে এলেন, এই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে বরং তাঁর বাবা কান্তিগোপালের প্রচারবিমুখ জীবনের গল্পটা এর আগের অনুচ্ছেদে আরও একবার না হয় পড়ুন। এই যে সকল লোকের মাঝে বসে একলা হতে পারার গুণটা আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহাতীতভাবে পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। আর হ্যাঁ, একজন বাঙালির প্রিয় মহানায়কের কোন ছবিতে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় কোন গান গেয়েছিলেন, তা খুঁজতে রীতিমতো ভিরমি খেতে হয়। তবে আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগীতের জগৎ সংক্ষিপ্ত হলেও বিশাল। সেই আলোচনা না-হয় অন্যদিন।
তথ্যসূত্র :
১. ‘কিছু গল্প, কিছু গান’, উইকএন্ড ক্লাসিক শো
২. আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, likhtebase.blogspot.com
৩. অন্তর্জাল
Powered by Froala Editor