সময়টা একেবারেই ভালো নয়। কিছুদিন আগেই দাঙ্গার রক্তের দাগ লেগেছে তিলোত্তমার গায়ে। ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার শুরু। খুব স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার জনজীবন বিপর্যস্ত এবং অস্থির। সেই সময়েই একবার গুন্ডাদের মুখোমুখি পড়েছিলেন তরুণ উত্তম। তখনও অবশ্য তিনি সেভাবে উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি।
আরও পড়ুন
নেতাজির জন্মদিনে গান লিখলেন উত্তমকুমার, সুরও দিলেন
তবে, গুন্ডাদের মুখে পড়লেন বলা ভুল। বলা ভালো, নিজেই মুখোমুখি হলেন। ‘নায়ক’ ছবির অরিন্দমের সঙ্গে বাস্তবের উত্তমের যে অনেক মিল তা আমরা অনুভব করতে পারি। সেই দৃশ্যের কথা মনে আছে? যেখানে এক পাশে দাঁড়িয়ে পার্ট মুখস্থ করছেন উত্তম। আর সামনে দাঁড়িয়ে মিছিলে বক্তৃতা রাখছেন তাঁর বন্ধু। এই অরিন্দমই যখন বিখ্যাত নায়ক হয়ে উঠলেন, তখন ইমেজ রক্ষার্থে সেই বন্ধুর অনুরোধেই মজদুরের সামনে আসতে অস্বীকার করেন। একটা দূরত্ব যে তৈরি হয়েছে আমরা বুঝতে পারি। বাস্তবেও দেখা যায়, মহানায়ক উত্তমকুমার সম্পর্কে একটা জনশ্রুতি চালু আছে যে, মর্নিংওয়াকের সময় এক বাম নেতার এনকাউন্টার দেখে ফেলার তিনি নাকি মুম্বই চলে গিয়েছিলেন, সাক্ষ্য-আইনি জটিলতা ইত্যাদি এড়াতে।
গুন্ডারা পথ আটকে জানতে চাইল, তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন। লোকটিকে ভেঙিয়ে হিন্দিতেই উত্তম জবাব দিলেন, যেখানে খুশি
কিন্তু যে উত্তমকুমার আদতে ছিলেন যুবক অরুণ, তিনি কি সামাজিক সমস্ত দায় এড়িয়ে যেতেন? না, তখনও জীবন যায়নি চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার। তখনও মানুষ তাঁকে কল্পলোকের রাজপুত্র করে তুলে রাখেনি। ফলে তরুণ উত্তম ছিলেন সেদিনের সেই তরুণ অরিন্দমের মতোই।
দাঙ্গা চলাকালীন কিছু কিছু রাস্তায় অবাঙালি ট্যাক্সিওয়ালাদের উপদ্রব বেড়েছিল। উত্তমের পাড়ার গলিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ওরা গলির মোড়ে মোড়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকত। এমনিতেই সে-সময় লোকে জমায়েত থেকে দূরে থাকতে চায়। ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলে। সেই সুযোগে রাতবিরেতে লোকজন ধরে চড়চাপড় বসিয়ে দু-পয়সা আদায় কররে নিতে এদের জুড়ি মেলা ভার ছিল। এমনকি মহিলারা অপমানিতও হয়েছেন। পুলিশের ভয়ে কেউ ট্যাঁ-ফো করেনি তেমন। আবার বাহুবলীদের ভয়টাও কাঁটা হয়ে থাকল। দেখেশুনে একদিন মাথায় খুন চেপে গেল উত্তমের। বন্ধুদের নিয়ে ইচ্ছে করেই একটু বেশি রাতে সে-রাস্তা দিয়ে ফিরছিলেন তিনি। যথারীতি গুন্ডারা পথ আটকে জানতে চাইল, তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন। লোকটিকে ভেঙিয়ে হিন্দিতেই উত্তম জবাব দিলেন, যেখানে খুশি। সঙ্গে সঙ্গে টাকা চেয়ে বসল গুন্ডারা। আর অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় সামনে এগিয়ে আসা সেই গুন্ডার গায়ে সজোরে এক ঘা বসিয়ে দিলেন উত্তম। মারের এতই জোর ছিল যে, সেই মুশকো ট্যাক্সিওয়ালাও ছিটকে পড়ে। সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখে রে রে করে এগিয়ে আসে বাকিরা। উত্তম ও তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ব্যাপক ধ্বস্তাধস্তি হয়। সেদিন জয় অবশ্য উত্তমদেরই হয়েছিল। তবে অন্যান্যদের চোট আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটেছিল উত্তমের। সে-কথা বাড়িতে জানাজানি হতে সে-আর এক কাণ্ড।
ফ্লপের পর ফ্লপ - এহেন ভাগ্যবিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়েও ইস্পাত-জেদে মাথা না নুইয়ে লড়াই করতে পারেন
‘নবকল্লোল’ পত্রিকায় একসময় ধারাবাহিক প্রকাশিত হত উত্তমকুমারের আত্মজীবনী, যা পরে অভীক চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। সেখানে খোদ মহানায়কের কলমেই এই ঘটনার উল্লেখ আছে। রূপোলি পর্দার রোম্যান্টিক নায়ককে অনেক সময়ই কল্পলোকের বাসিন্দা মনে হয়। আজও সেই ম্যাজিক অটুট। কিন্তু সমস্ত ইন্দ্রজালের নেপথ্যে একজন শক্ত মনের মানুষ যে আছেন, তা অনস্বীকার্য। যিনি ফ্লপের পর ফ্লপ - এহেন ভাগ্যবিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়েও ইস্পাত-জেদে মাথা না নুইয়ে লড়াই করতে পারেন। আবার সামাজিক কোনও প্রয়োজনীয়তাতেও রুখে দাঁড়াতে পারেন। ইনিই আমাদের উত্তমকুমার। যিনি মধ্যবিত্ত দোটানায় চাকরি ছাড়তে ভয় পান, আবার অভিনয়ের তাগিদে সে-চাকরির মায়া পুষেও রাখতে পারেন না। যিনি ছাপোষা যুবকের মতোই প্রেমে পড়েন, আবার প্রেমিকার বাবার যদি দারোয়ান ডাকিয়ে মারের ব্যবস্থা করেন, সে-ভয়ও পান। এই পারা, না-পারা আবার বিক্ষুব্ধ সময়ে রুখে দাঁড়ানো একরোখা যুবক – এই সব মিলিয়েই তিনি এমন একজন, যিনি আমাদের স্বপ্নের নায়ক তো অবশ্যই, তাঁর জীবনের ঘটনাবলি জানায়, বাস্তবের মাটিতেও তিনি যথার্থ নায়ক-ই বটে।
আরও পড়ুন
উত্তমের চোখে তখন আদর্শ নায়ক অসিতবরণ, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ইচ্ছে বিমল রায়ের মতো পরিচালক হবেন
Powered by Froala Editor