সত্তরের দশকের কলকাতা। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে তখন একটু একটু করে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বাঙালি। বাংলার ঘরে ঘরে গ্রামোফোন রেকর্ডে তখন বাজছে আধুনিক গান। ঠিক সেইসময় বাবার হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে এল এক বছর কুড়ির যুবক। তখনও কৈশোরের লাবণ্য ঘিরে রেখেছে তাকে। আকাশবাণীতে তার সঙ্গীতের আসরও বসল। আধুনিক গান নয়, ছেলেটি সরোদ বাজিয়ে শোনাবে। সেদিন সেই সুরের মূর্ছনায় অবাক হয়েছিল সারা দেশ। এত অল্প বয়সে এত সুন্দর সুর সৃষ্টি করা যায়? একে একে ডাক আসতে থাকল দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, শ্রীনগর থেকে।
করোনা ভাইরাস কেড়ে নিল সেই কিংবদন্তিরই প্রাণ। রবিবার সকালে প্রয়াত হলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সরোদ শিল্পী ওস্তাদ শাহদাত হোসেন খান। ১২ দিন আগে তাঁর শরীরে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। চিকিৎসকদের অনেক চেষ্টাতেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না তাঁকে। মাত্র ৬১ বছর বয়সে সঙ্গীতের জগত থেকে বিদায় নিলেন তিনি। ওস্তাদ শাহদাত হোসেন খানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে নতুন নক্ষত্রকে চিনে নিতে সেদিন দেরি করেননি তাবৎ শিল্পীরা। আর হবে নাই বা কেন? শাহদাত হোসেন খানের রক্তে যে বইছে সুর। ১৯৫৮ সালে কুমিল্লা জেলায় জন্ম। ঠাকুর্দা ওস্তাদ আয়েত আলি খান ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ভাই। বাবা ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানও ছিলেন বিখ্যাত সরোদশিল্পী। আর দুই জ্যাঠা ওস্তাদ আলি আকবর খান এবং ওস্তাদ বাহাদুর খান। ছোটো থেকেই সঙ্গীতময় তাঁর জীবন।
মাত্র ৭ বছর বয়সে তবলা এবং সরোদে হাতেখড়ি। একে একে নানা রাগ-রাগিণী শিখে নিতে সময় লাগেনি। ১৯৭২ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ঢাকার আলাউদ্দিন মিউজিক কনফারেন্সে আত্মপ্রকাশ তাঁর। সেদিন সঙ্গে ছিলেন ওস্তাদ বাহাদুর খান। তারপর একে একে সারা পৃথিবী জয় করলেন ওস্তাদ শাহদাত হোসেন খান। শেষ জীবনে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই অবশ্য করেছেন ইউরোপের মাটিতে। কিন্তু শিকড়ের টান ভোলেননি কখনও। এই বাংলাদেশই তো তাঁকে সুর চিনতে শিখিয়েছে। এখান থেকেই পেয়েছেন একুশে পদক। আলি আকবর কলেজ থেকে পেয়েছেন বাদ্য-অলঙ্কার সম্মান। ওস্তাদ শাহদাত হোসেন খানের মৃত্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল, সেকথা বলাই বাহুল্য।
Powered by Froala Editor