উত্তরপ্রদেশের একটি ছোট্ট জেলা রামপুর। তখনও ইউনিয়ন জ্যাক উড়ছে ভারতের মাটিতে। আর রামপুরের মসনদে বসে আছেন নবাব হামিদ আলি খান বাহাদুর। তাঁর সভা আলো করে রেখেছেন উস্তাদ উজীর খাঁ। তিনি নাকি স্বয়ং তানসেনের বংশধর! সুর আর স্বরের জাদুতে খাঁ সাহেব আচ্ছন্ন করে রাখেন গোটা সভা। কত লোকে তাঁর কাছে সঙ্গীত শিখতে চায়। সেরকমই একদিন উজীর খাঁ’র বাড়ির সামনে হাজির হলেন এক তরুণ। নিজের গ্রাম ব্রাহ্মণবেড়িয়া ছেড়ে রাস্তায় নেমেছেন স্রেফ সঙ্গীতের জন্য। উজীর খাঁ-র নাম অনেক শুনেছেন; ওঁর কাছেই শিখতে চান তিনি। সুদূর বাংলা থেকে ঘুরে ঘুরে তাই হাজির হয়েছেন রামপুরে। নিশ্চয়ই খাঁ সাহেব তাঁকে ফেরাবেন না…
মানুষটির আশাই সার। রোজ উজীর খাঁ সাহেবের বাড়ির দিকে রওনা দেন; আর যাওয়ার পরই বাড়ির দারোয়ান ফিরিয়ে দেন তরুণটিকে। একদিন, দুদিন, তিনদিন… অপেক্ষা বাড়তেই লাগল। দারোয়ানকে টপকে উস্তাদজির কাছে পৌঁছতেই পারছেন না তিনি। তাহলে? এতদূরে আসা তো সঙ্গীতের জন্যই। তাহলে কি সুরের সাগরে ডুব দিতে পারবেন না তিনি? ব্যর্থ হবে এই জীবনটাও? এভাবে বাঁচতে পারবেন না তিনি। একবার তাকালেন উজীর খাঁ-র বাড়ির বন্ধ দরজার দিকে। তারপর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলেন তরুণ আলাউদ্দিন খাঁ। গন্তব্য, আফিমের দোকান। এই জীবন আর রাখবেন না আলাউদ্দিন…
একজন শিল্পীর হতাশা এভাবেই বেরিয়ে এসেছিল সেদিন। হয়তো বাবা আলাউদ্দিন খাঁ নামের কোনো মহীরুহ জন্ম নিতই না। তার বদলে নামের পাশে লেখা থাকত আরও এক শিল্পী, সঙ্গীতপ্রেমী তরুণের হতাশ যাত্রার বর্ণনা। তাহলে এখানেই ইতি! আত্মহত্যার আগে শেষবারের মতো মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেন আলাউদ্দিন খাঁ। কিন্তু প্রার্থনায় মন বসছে না; একরাশ দুঃখ যেন কালো ছায়া হয়ে ঘিরে ধরেছে তাঁকে। চুপচাপ বসে রইলেন মসজিদ চত্বরে। একটি তরুণ কালো মুখ করে বসে আছে— এই দৃশ্য অচিরেই চোখে পড়ল ওখানকার মৌলবির। ‘বেটা, তোমার কী হয়েছে? এমন করে বসে আছো কেন?’ ধর্মস্থানে, ভগবানের কাছে মিথ্যে কথা বলতে নেই। মৌলবি সাহেবের কাছে সমস্তটা বললেন তরুণ আলাউদ্দিন। চোখে জল তাঁর।
আর এটাই খাদের ধার থেকে তাঁকে টেনে আনল মাটিতে। সমস্ত শুনে মৌলবি সাহেব চিঠি লিখলেন নবাব হামিদ আলি খান-কে। সেই চিঠি কোনোক্রমে নবাবের কাছে নিয়ে গেলেন আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁর সুপারিশেই উজীর খাঁ-র কাছে নাড়া বাঁধলেন; সরোদের তারে বেজে উঠল মেঘমল্লার। যাওয়ার আগে নবাব, আলাউদ্দিনের কাছ থেকে আফিমের গুলির কৌটোটা চেয়ে নিলেন। ব্যস, সামনে খুলে গেল অনন্ত জগৎ! যেখানে ডুব দিলেন আলাউদ্দিন খাঁ; আমাদের আপন উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খাঁ…
বাবা-মায়ের আদরের ‘আলম’ তিনি। ছোটো থেকেই দেখেছেন দারিদ্র কী জিনিস। কিন্তু কোনোকিছুই সঙ্গীতের যাত্রার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সেই ছোটো বয়সেই একটি চরম গুণ নিজের মধ্যে আয়ত্ত করেছিলেন— কেবলমাত্র টাকার পেছনে না ছোটা। বিশ্বের দরবারে ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এত মহান সঙ্গীতসাধকের জন্মদাতা তিনি, থাকতেন ফকিরের মতো। ঠিক যেন ধ্যানমগ্ন এক সাধক। জাগতিক কোনোকিছুর দিকেই তাঁর খেয়াল নেই। মাইহারে তাঁর একমেবাদ্বিতীয়ম ‘মদিনা ভবন’-এর ভেতরেই জায়গা পান দেবী সরস্বতী, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ। যেন একদিকে মক্কা, অন্যদিকে মহাদেব…
সুর, সঙ্গীত এক সাধনার জিনিস। তাকে আরাধনা করতে গেলে বিশেষভাবে প্রস্তুত করতে হয় নিজেকে। সেখানে ফাঁকি দেখলেই আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের মাথায় রক্ত উঠে যেত। যারা শিখতেন, তাঁরাও তটস্থ হয়ে থাকতেন। একটু এদিক ওদিক হলে রীতিমতো মারধরও করতেন। নিজের নানা সাক্ষাৎকারে এমন নানা ঘটনার কথাই উল্লেখ করেছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তিনি ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের অন্যতম প্রিয় ছাত্র, সঙ্গে জামাতাও। সাধারণত উস্তাদজির শেখানো জিনিস তাড়াতাড়িই তুলে ফেলতেন রবিশঙ্কর। যেদিন সেই নিয়মে ছেদ পড়ত, সেদিন মুখ থমথমে হয়ে যেত উস্তাদজির। স্নেহবশত রবিশঙ্করকে হয়ত মারতে পারতেন না; সেই রাগ অন্য জায়গায় উগরে আবারও ফিরে আসতেন। কতবার রবিশঙ্কর ভেবেছেন, আর নয়; এবার বাড়ি ফিরে যাব। কিন্তু সঙ্গীতের নাড়ি ছিঁড়ে বেরনো কি এতই সোজা?…
আরও পড়ুন
‘এইডা শিখাইলাম তগো? আমার নাম ডুবাইলি’ – রবিশঙ্কর-বিলায়েতের যুগলবন্দিতে ক্রোধ গুরু আলাউদ্দিনের
ভারতের এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কি বিদেশে মান্যতা পাবে? তাঁরা কি বুঝতে পারবে এর মাহাত্ম্য? দীর্ঘদিন এই সংশয় নিয়ে ঘুরেছেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ। এই সংশয় নিয়েই একবার প্যারিসে গান শোনাতে গেছেন। সঙ্গে রয়েছে তাঁর প্রিয় সরোদ। এমন সময় হাজির হল বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় মেয়ে। তাঁরা উস্তাদজির কাছে সঙ্গীত শুনতে চান। এঁরা কি আদৌ বুঝবে সরোদের কথা? ভারতীয় ঘরানার কথা? নাকি শুধুই ‘ফ্যাশন’? একটু একটু করে সময়ের কাঁটা এগিয়ে চলল। প্রায় তিন ঘণ্টা অতিক্রান্ত। সব শেষে আলাউদ্দিন খাঁ চোখ খুললেন। এ কী আশ্চর্য! সামনে বসে থাকা ইউরোপীয় মেয়েরা তখনও চোখ বন্ধ করে রয়েছেন। আর সেই বন্ধ দরজা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। যেন মায়া কাটিয়ে বেরোতে পারছেন না। আলাউদ্দিন নিশ্চিন্ত হলেন। আর কেউ থামাতে পারবে না এবার…
টাকার ওভাবে একটা সময় নাইটক্লাবেও কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সঙ্গীতের থেকে বিচ্যুত হবেন না— এমন ধনুকভাঙা পণই আঁকড়ে বেড়ে উঠলেন আলাউদ্দিন খাঁ। সরোদের মানচিত্রে তাঁকে আটকে রাখা উচিত হবে না। তিনি যে কত রকম যন্ত্র বাজাতে পারতেন, তার কোনো ঠিক ছিল না। রবিশঙ্করকে সেতার শেখাচ্ছেন, আবার নিজের সন্তান উস্তাদ আলি আকবর খাঁ-কে শেখাচ্ছেন সরোদ। মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীর জন্য থাকল সুরবাহার, পান্নালাল ঘোষ শিখলেন বাঁশি। যেন সঙ্গীতের এক ঘূর্ণাবর্ত! এমনকি নিজেও তৈরি করেছিলেন বেশ কিছু শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্র। এমন বর্ণময় জীবন, কিংবদন্তিসম বেঁচে থাকা; কখনও ইচ্ছা করে না আত্মজীবনী লিখতে? শেষ জীবনে যখনই এই প্রশ্ন শুনেছেন, উত্তর এসেছে, ‘যা সরোদে বলতে পারিনি, তা কি মুখে বলতে পারব?’ একের পর এক রাগ-রাগিনির ভেতর দিয়ে যার যাত্রা, তিনি কিনা বলছেন আরও কয়েক জন্ম দরকার সঙ্গীত শেখার জন্য! মাইহারের সূর্যাস্তের দিকে একমনে চেয়ে থাকেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ। চোখে লেগে আসে রক্তিম আবেগ, বেজে ওঠে গৎ। আফিমের গুলি কি ধুয়ে নিয়ে গেছে নদীর জল? আলাউদ্দিন বেজে ওঠেন…
তথ্যসূত্র-
আরও পড়ুন
‘হিন্দু ললনাদের প্রতিরাত্রে বিয়ে দিচ্ছেন বিসমিল্লা খান’; যাঁর কাছে সুরই হয়ে উঠেছিল ধর্মাচরণ
১) ‘আলম’, শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সুইসাইড নোট ও দৈত্য’, রজতকান্তি রায়, প্রথম আলো
৩) ‘আমাদের মৃতদেহে প্রাণ দান করিলেন’, জাহীদ রেজা নূর, প্রথম আলো
আরও পড়ুন
ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ আর পণ্ডিত রবিশঙ্করের ডুয়েলের 'কাহানি'
৪) ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ: বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হয়ে ওঠার উপাখ্যান’, নায়িম আহমেদ, রোর বাংলা
Powered by Froala Editor