১৯৬৯ সালের কলকাতা। চারিদিকে উত্তাল সময়। তার মধ্যেও পাক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁ ও বারগুলো মেতে উঠত গানে, গল্পে, আনন্দে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই অঞ্চলটা যেন স্বপ্নের মহল। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রিঙ্কার্স বার। রাতের আলোয় এখানে শুরু হয় গান। তালে তালে নেচে ওঠেন বারের অতিথিরা। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন বছর বাইশের এক তরুণী - নাম ঊষা বৈদ্যনাথ সোমেশ্বর স্বামী। লম্বা চেহারা, বেড়ে ওঠা তামিল পরিবারে। চেন্নাই থেকে কলকাতার এই নৈশ রজনীতে হাজির হয়েছেন তিনি— গান গাইতে। কিন্তু বাকিদের থেকে যেন একটু আলাদা এই তরুণী। ট্রিঙ্কার্সের মঞ্চে লাইভ গান গাইছেন তিনি, তাও শাড়ি পরে! এক মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন অনেকে।
সেই সময়টায় কেউ পার্ক স্ট্রিটের বারে গান গাইছে শাড়ি পরে, এমনটা কল্পনাও করতে পারেন না কেউ। তাও সেই বারের নাম ট্রিঙ্কার্স! কিন্তু ঊষা তো নিজের জায়গা থেকে সরবেন না। শাড়ি পরেই গান ধরেছেন তিনি। অবশ্য গান শুরু হওয়ার পর সবাই সবকিছু ভুলে গেলেন। কী তেজ গলায়! এই মেয়ে যেন জাদু জানে! সেদিন থেকেই রাস্তাটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তাঁর। আর আজ? ৭৩ বছর বয়স হয়ে গেল। এখনও এতটুকুও ক্লান্ত নন ঊষা। ঊষা উত্থুপ। কলকাতায় জন্ম না নিলেও, তিনি যে এই শহরেরই রানি! তিলোত্তমার একান্ত আপন…
যে গলার জন্য আজ গোটা ভারতে তাঁর নাম, এই গলার জন্যই একদিন স্কুলের মিউজিক ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ঊষা উত্থুপকে। মেয়ে হয়েছ, একটু নরম কোমল গলা না হলে হয়! এত ভারী গলা চলবে না। এদিকে গান ছাড়াও যে এক মুহূর্ত চলবে না তাঁর। বড়োই হয়েছেন নানা স্বাদের গান শুনে। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে পপ— সব জায়গায় ঊষার সাবলীল যাতায়াত। মাত্র নয় বছর বয়স। তখনই রেডিওতে গান গাওয়ার ডাক পেলেন তিনি। গানই হবে জীবন, এটা কি তখন থেকেই ভেবেছিলেন ছোট্ট ঊষা?
একে একে সমস্ত স্টিরিওটাইপ ভেঙেছেন ঊষা উত্থুপ। বার সিঙ্গারদের নিয়ে তখনও সমাজে এক ভ্রান্ত ধারণা, একটু চোখ বেঁকিয়ে তাকানো। কিন্তু তাঁরাও যে একজন শিল্পী, তাঁদেরও যে প্রতিভা আছে সেটা কেউ বুঝতেও চান না। একটা সময় কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁ, হোটেল, বার থেকে জন্ম নিয়েছেন একের পর এক শিল্পী। আর সেই ঢেউয়ে এসেই মিশলেন ঊষা উত্থুপ। তাও একদম নতুন আঙ্গিকে। শাড়ি, কপালে মোটা টিপ, যাকে বলে পরিশীলিত, সনাতন ভারতীয় পোশাক। আর গান? সেই সময় যেখানে যেখানে গান গেয়েছেন ঊষা, সব জায়গায় শ্রোতারা ভরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। দিনের শেষে আরও একটি কাজ করেছিলেন তিনি। ট্রিঙ্কার্স বারে তাঁর হাত ধরেই প্রথম ঢুকল রবীন্দ্রসঙ্গীত। পার্ক স্ট্রিটের নাইট বারেও যে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর গান আসতে পারে, ঊষা উত্থুপ না থাকলে জানতেই পারত না বাঙালি। সেদিনের সেই বৈপ্লবিক মুহূর্তের সাক্ষী থেকেছিলেন স্বয়ং জ্যোতি বসু। হাততালিও পেয়েছিলেন অনেক…
কপালে আগে থেকেই ছিল কালো টিপ। এবার সেখানে জায়গা নিল ‘ক’ অক্ষরটি। ঊষা উত্থুপ বললেই বাঙালির এই ছবিটিই মাথায় আসবে। একবার দিল্লির ওবেরয় হোটেলে গেছেন গান গাইতে। হঠাৎ হোটেলে হইহই রব। কী হল? না, নাইটবারে হাজির হয়েছে একটি সিনেমার শুটিংয়ের দল। আর সেই দলেই ছিলেন দেব আনন্দ। বলিউডের ‘চিরকুমার’। তিনিই ঊষা উত্থুপকে প্রথমবার দেখলেন সেই আসরে। এমন গলাকে কি কাজে লাগাবে না বলিউড? ১৯৭০ সাল। লক্ষ্মীকান্ত প্যায়ারেলালের সুরে গাইলেন ‘দেবী’ সিনেমায়। ঠিক পরের বছরই, স্বয়ং রাহুল দেববর্মণের সুরে ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক। আর ফিরে তাকাতে হয়নি ঊষা উত্থুপকে। ‘এক দো চা চা চা’, ‘হরি ওম হরি’, ‘শান সে’, ‘রাম্বা হো’… তালিকা যে অনেক দীর্ঘ। আজও এই গান ভারতের প্রতিটা কোণায় বাজে। সময় এগিয়েছে, গঙ্গা দিয়ে কত জল চলে গেছে সাগরে। কিন্তু ঊষা উত্থুপ আর তাঁর গান কখনও ফিকে হয়ে যায়নি…
২০১১ সাল ঊষার জীবনে এক স্মরণীয় বছর। ‘সাত খুন মাফ’ ছবির একটি বিশেষ গানের জন্য গায়িকা খুঁজছিলেন বিশাল ভরদ্বাজ। গানটার যা আবেদন, তাতে একজনই হয়তো ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন। বিশাল গেলেন ঊষা উত্থুপের কাছে। বাকিটা? ফিল্মফেয়ার, আইফার মতো ভারতের সেরা পুরস্কারের পাশাপাশি গানটিও কাল্ট তকমা পেয়ে গেল। ঊষা উত্থুপের সঙ্গে আমরাও পেয়ে গেলাম ‘ডার্লিং’কে। লেখাটি পড়তে পড়তে আপনিও কি গুনগুন করে উঠলেন না?
আরও পড়ুন
অপরিচিত কণ্ঠে হঠাৎ গুনগুন, চলন্ত ট্রামেই নিজের গান শুনতে পেলেন আব্বাসউদ্দিন
মুম্বইতে বড়ো হওয়া, তামিলনাড়ুতে শেকড়; তবুও প্রাণের কাছে রেখেছেন এই কলকাতাকে। তিনি যে মনেপ্রাণে বাঙালি। তিনি যে এই শহরের ‘দিদি’। এখানেই পেয়েছেন নিজের জীবনসঙ্গীকে, এখান থেকেই তাঁর খ্যাতি, কেরিয়ারের শুরু। ট্রিঙ্কার্সকে কি এত সহজে ভুলতে পারবেন? হিন্দি, ইংরেজি, মালয়ালমের পাশাপাশি বাংলাতেও অজস্র গান গেয়েছেন। অ্যাড জিঙ্গলগুলোতেও তাঁর গলা নজর কাড়ে সবার। এখনও সমান তালে গান গেয়ে চলেছেন তিনি। কখনও আইপিএলের মরসুমে কলকাতার খেলা দেখতে চলে যাচ্ছেন, আবার অনুষ্ঠানের মাঝে অনায়াসে বেছে নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথকে। ঊষা উত্থুপ এভাবেই বেঁচে আছেন গানে, বেঁচে আছেন বাংলায়। বয়স তাঁকে কীভাবে ছোঁবে!
তথ্যসূত্র –
১) ‘নাইট ক্লাব সিঙ্গার হয়ে কোনও আপশোস নেই: ঊষা উত্থুপ’, উপালি মুখার্জি, এনডিটিভি মুভিজ
আরও পড়ুন
সলিল চৌধুরীর গান গাইলে থাকা যাবে না শান্তিনিকেতনে, রেকর্ডিং করেও পিছিয়ে এলেন কণিকা
২) ‘ট্রিঙ্কার্সের ৬০, ঊষা উত্থুপের ৫০’, নেহা বাঁকা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা
৩) ‘স্টেজে আজও জিঙ্গল গাই’, অভিজিৎ সেন, এই সময়
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
তাঁর হাত ধরেই হিন্দি নাটকে অভ্যস্ত হয়েছিল বাঙালি, উষার প্রয়াণে শেষ হল একটি অধ্যায়