সোভিয়েত পতনের পরেও শেষ হয়নি ঠান্ডা যুদ্ধ, নতুন করে শুরু প্রস্তুতি

২০১৯ সালে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির দুই অধ্যাপক স্টিফেন ল্যামি এবং রবার্ট ডি ইংলিশ সমসাময়িক পরিস্থিতি বিচার করতে গিয়ে ব্যবহার করেছিলেন একটি শব্দ। ‘নিউ কোল্ডওয়ার’ (New Cold War)। অর্থাৎ ঠান্ডা যুদ্ধ আবার শুরু হয়ে গিয়েছে। মার্কিন-চিন বৈদেশিক সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে এমনটাই মন্তব্য করেছিলেন তাঁরা। এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলেছে গত ৩ বছরে। কলম্বিয়া ইউনভার্সিটির অধ্যাপক থমাস ক্রিস্টেনসেন স্পষ্ট বলেছিলেন, দ্বিতীয় ঠান্ডাযুদ্ধের কোনো সম্ভাবনাই আর নেই। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শগত দ্বন্দ্বেরই আর কোনো জায়গা নেই। পৃথিবীর প্রতিটা রাষ্ট্রশক্তিই বাজার অর্থনীতির কাছে মাথা নত করেছে। চিন তো বটেই।

তবে ঠান্ডা যুদ্ধ মানে শুধুই পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব নয়। বরং মতাদর্শের লড়াই সেখানে একেবারেই গৌণ একটি বিষয়। যুদ্ধে মতাদর্শের দ্বন্দ্ব থাকতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু যা থাকবেই, তা হল সামরিক দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকা (United States) ও রাশিয়ার (Russia) দ্বন্দ্বও ছিল সামরিক। শুধু দুই দেশের হাতেই পরমাণু বোমার মতো শক্তিশালী মারণাস্ত্র মজুত থাকায় সেই যুদ্ধ সরাসরি ঘটার সুযোগ পায়নি। দুই দেশই জানত, এতে নিজেদের ক্ষতি হবে। আর বর্তমানে আবারও সেই দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এবং তাও আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যেই।

৮০-র দশকের পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সবচেয়ে সবচেয়ে বড়ো বিপর্যয় অবশ্যই ইউক্রেনের সোভিয়েত ত্যাগ। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়াই নয়, বরং শেষ পর্যন্ত ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে যোগ দেয় ইউক্রেন। এদিকে তার আগেই রাশিয়ার শাসন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে আফগানিস্তান। মধ্যপ্রাচ্যে সমাজতান্ত্রিক শাসন গড়ে তোলার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করতে হয়। সোভিয়েতের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নও মুছে যায় চিরতরে। আর সেই জয়কে সবরকমভাবে উদযাপন করতেই যেন মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক অভিযান চালায় আমেরিকা। দুই দশকের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে সামরিক শাসন সেদিকেই ইঙ্গিত করে।

এর মধ্যে আফগানিস্তানে সামরিক শাসনেরও অবসান ঘটেছে। ইরাককে ঘিরে রাশিয়া ও আমেরিকার একসঙ্গে সামরিক আধিপত্য গড়ে তোলার সম্ভাবনাও অতি ক্ষীণ। বরং নতুন করে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। বাসের-আল-আসাদের সঙ্গে মৈত্রীর সুযোগ নিতে প্রস্তুত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আমেরিকাও সবরকমভাবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রভাব বিস্তার করতে প্রস্তুত। বিশ্বের সামনে সন্ত্রাসবাদবিরোধী রাষ্ট্রীয় শক্তি হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করার সবচেয়ে বড়ো সুযোগ তো এটাই। এদিকে সোভিয়েত গঠনের প্রায় কোনো সম্ভাবনাই আর নেই। তবুও পূর্ববর্তী সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলিকে নিয়ে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের বিপরীতে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন তৈরি করেছেন পুতিন।

আরও পড়ুন
নোবেলজয়ের দিনেই দেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগ রাশিয়ার

এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে সামরিক প্রস্তুতিও। একদিকে মার্কিন সেনাশিবিরগুলির আশেপাশেই গোয়েন্দা শিবির গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু করেছে রাশিয়া। অন্যদিকে একাধিক সামরিক যুক্তি ভঙ্গ করার অভিযোগ উঠছে ন্যাটোর বিরুদ্ধেও। আর এই দ্বৈরথের মধ্যে আবারও জড়িয়ে পড়তে চলেছে অসংখ্য ছোটো ছোটো দেশ। এবারের ঠান্ডা যুদ্ধে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন নেই। উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনৈতিক মডেলের প্রশ্নটিও ব্রাত্য। কেবল আধিপত্য বিস্তারের লড়াইটা থেকে গিয়েছে। সোভিয়েতের পতন হলেও যে রাশিয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। আর তাই আমেরিকার বিরুদ্ধে আবারও এক দ্বিতীয় বিশ্ব তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে, যা অপ্রত্যাশিত ছিল না কোনোভাবেই।

আরও পড়ুন
গোপন সেনাবাহিনী রয়েছে রাশিয়ার, পরিত্যক্ত ট্যাবলেটের সাহায্যে রহস্য ফাঁস

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ছেড়ে গেছে অধিকাংশ মানুষ, মৃত্যুর অপেক্ষায় রাশিয়ার এই শহর

Latest News See More