ক্রমাগত বেজে চলেছে বাড়ির ল্যান্ডলাইন। আর তার শব্দেই ঘুম ভেঙে গেল লেফটেন্যান্ট জ্যাক র্যাভলের। ঘুম চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে খানিক অবাকই হলেন তিনি। সবে পাঁচটা। এই ভোর রাতে আবার কার ডাক এল! বিছানা ছেড়ে ড্রইংরুমে গিয়ে কানে তুলে নিলেন ফোনের রিসিভার। আরও একবার অবাক হওয়ার পালা। ফোন এসেছে মার্কিন বিমানবাহিনী থেকে। কিন্তু তিনি যে ছুটি নিয়েই বাড়িতে এসেছে সদ্য। তবে হঠাৎ এমন তলব? ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে সাংকেতিক ভাষায় হুকুম এল, দ্রুত তাঁকে হাজিরা দিতে হবে মার্কিন সেনা ঘাঁটিতে। সেখানে নাকি তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে জরুরি বিমান। কিন্তু ঠিক কী কাজের জন্য এই জরুরি তলব— স্পষ্ট করে বলা হল না কিছুই।
সেনা ছাউনিতে যাওয়ার পর পরিষ্কার হল বিষয়টা। সিক্রেট মিশন ‘ব্রোকেন অ্যারো’-র বিস্তারিত তথ্য শুনে রীতিমতো শিউরে উঠলেন তিনি। শিউরে ওঠার মতোই ঘটনা। দু’-দুটি পারমাণবিক বোমা নিয়ে নর্থ ক্যারোলিনার বুকে ভেঙে পড়ে মার্কিন যুদ্ধবিমান। আর সেই বোমা নিষ্ক্রিয় করতেই সেখানে যেতে হবে তাঁকে। এ যে নিজে থেকে যমের দুয়ারে গিয়ে হাজির হওয়া! তারপর?
শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটি। ১৯৬১ সাল। যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েতের মধ্যে তখন নীরবেই চলছে এক বৃহত্তর যুদ্ধ। যার পোশাকি নাম ‘কোল্ড ওয়ার’। সরাসরি যুদ্ধ না নেমেও, বিশ্বের দুই অন্যতম শক্তিধর দেশ খেলে যাচ্ছে কূটনৈতিক যুদ্ধ। ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছে তাদের সামরিক ক্ষমতা, অস্ত্রের ভাণ্ডার। কিছুদিন ছাড়া ছাড়াই পরীক্ষা হচ্ছে আণবিক অস্ত্রের। তবে সবটাই হচ্ছে অত্যন্ত গোপনে।
ঠিক সেভাবেই প্রোটোটাইপের সফল পরীক্ষার পর সেমুর জনসন সেনা ঘাঁটি থেকে বি৫২ বোমারু বিমানে দুটি আণবিক বোমা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল গোপন অস্ত্রভাণ্ডারে। মূলত থার্মো-নিউক্লিয়ার বোমা ছিল সেগুলি। অর্থাৎ, সহজ কথায় হাইড্রোজেন বোম। সেমুর জনসন বিমানবন্দর থেকে উড়ানও দেয় বিমানটি। তবে খানিকটা পথ অতিক্রম করার পরেই বিমান চালকদের নজরে পড়ে অস্বাভাবিকতা। মুহূর্তের মধ্যে বিমানের জ্বালানি তলানিতে এসে ঠেকল! কিন্তু তার কারণ তখনও বিন্দুমাত্র অনুমান করতে পারেননি তাঁরা।
আরও পড়ুন
সিন্থেটিক ড্রাগে অভ্যস্ত ছিল নাৎসি সেনারা, ‘নেশা’র অভাবেই আত্মহত্যা হিটলারের?
ঠিক হল আকাশপথেই রি-ফুয়েলিং হবে বিমানের। সেই মতো ডাকও গেল সেনাবন্দরে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই এসে হাজির হয় আরো একটি ট্যাঙ্কার বিমান। জ্বালানি ভরতে গিয়েই দ্বিতীয় বিমান চালকের চোখে পড়ল ব্যাপারটা। ফাইটার জেটের ডানা দিয়ে গল গল ঝরে পড়ছে তেল। ফলত, জরুরি অবতরণ ছাড়া বাঁচার পথ নেই। সতর্কতা মেনেই দ্রুত সিদ্ধান্ত বদল করলেন বি৫২ চালক। একশো কিলোমিটারের মধ্যেই নর্থ ক্যারোলিনা সেনা ঘাঁটি। সেখানেই নামবে যুদ্ধবিমানটি। কিন্তু ততক্ষণে যে দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আগুন জ্বলে উঠল বিমানে। তারপরই বিস্ফোরণ। নর্থ ক্যারোলিনার গোল্ডসবরোর কাছেই ভেঙে পড়ল যুদ্ধবিমানটি। সবমিলিয়ে ৮ জন সেনা ছিলেন সেই বিমানে। তার মধ্যে ৫ জন ক্রু বেরিয়ে আসতে পারলেও প্রধান দুই চালক-সহ আরেক মেজর মারা যান দুর্ঘটনাতে। আর বোমা দুটি?
আরও পড়ুন
তৃষ্ণার্ত সেনানীরা, বিশ্বযুদ্ধে বিয়ার ফেরির দায়িত্বে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান!
বিমান বিস্ফোরণের আগেই সে দুটিও আছড়ে পড়ে প্লেন থেকে। কিংবা স্বয়ং চালকই বোমা দুটির পথ খুলে দিয়েছিলেন ইচ্ছাকৃতভাবে। কারণ বিমানের বিস্ফোরণের উষ্ণতায় ট্রিগার হয়ে যেতে পারে থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা। অবশ্য দুটি বোমার ক্ষেত্রেই অন করে দেওয়া হয়েছিল সেফটি প্রোটোকল। দুটির মধ্যেই ব্যবস্থা ছিল স্বয়ংক্রিয় প্যারাসুটের। তবে গোলযোগ বাঁধে অন্য জায়গায়। প্রথম বোমাটি মাটি স্পর্শ করার আগেই, তার প্যারাসুট আটকে যায় একটি বিশাল গাছের ডালে। ফলে মাটি স্পর্শ করার আগে অনেকটাই কমে যায় গতি। মাটিতে একফুটের মতো গেঁথে গেলেও এড়িয়ে যায় বিস্ফোরণ। কিন্তু দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ঘটে ভিন্ন ঘটনা। সোজা কৃষি জমির ওপরে খসে পড়ে সেটি। এই বোমাটির প্যারাসুট খুলতেও দেরি হয়ে গিয়েছিল বেশ খানিকটা। ফলত ৭০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে তা আঘাত করে মাটিতে। নরম আবাদি জমি হওয়ায় তা ভেদ করে বোমাটি ঢুকে যায় প্রায় ৫০ ফুট গভীরতায়।
আরও পড়ুন
চের্নোবিলের তিন দশক আগেই ঘটেছিল বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক দুর্ঘটনা
পরিস্থিতি যে কতটা ভয়ঙ্কর, তা ঘটনাস্থলে পৌঁছেই টের পান বোম ডিস্পসাল ইউনিটের সদস্যরা। না, এই বোমাটি আর আস্ত নেই। মাটির সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। তদন্তে প্রথম যে জিনিসটি তাঁরা নরম কাদা মাটির মধ্যে খুঁজে পান, তা হল বোমার সেফটি সুইচ। সঙ্গে সঙ্গেই খবর দেওয়া হয় কিংবদন্তি পদার্থবিদ ও গবেষক ডঃ রালফ ল্যাপকে। যিনি জড়িত ছিলেন ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সঙ্গেও। অন্যদিকে চলতে থাকে বোমার উদ্ধার কাজ। তবে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল শীতের কনকনে ঠান্ডা। পাশাপাশি জলাজমিতে খননের ফলে বেরিয়ে আসছিল ভূগর্ভস্থ জল।
প্রফেসর রালফ যখন এসে পৌঁছালেন ততক্ষণ যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। আঁতকে উঠলেন আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। হাইড্রোজেন বোমের দুটি অংশ থাকে। একটিতে পারমাণবিক বোমার জ্বালানি। অর্থাৎ, ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম জাতীয় তেজস্ক্রিয় পদার্থ। তার বিস্ফোরণে উৎপন্ন তাপেই দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে থাকা হাইড্রোজেনের সংযোজন বিক্রিয়াকে ট্রিগার করে। রালফ দেখলেন, মূল হাইড্রোজেন বোম ট্রিগার হয়নি ঠিকই কিন্তু প্রথম প্রকোষ্ঠটি ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বোমা থেকে। তার বিস্ফোরণ না হলেও খুলে গেছে তার বাইরের শিশার আবরণ। এতএব, ক্রমাগত নির্গত হচ্ছে তেজস্ক্রিয় রশ্মি। আর বোম নিষ্ক্রিয়করণ কর্মীরা কোনো বিশেষ স্যুট ছাড়াই কাজ করছিলেন বিগত এক সপ্তাহ। তাঁর নির্দেশেই দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বোমার পারমাণবিক কোরটি। আর বাকি অংশটা?
না, প্রায় দু’মাসের চেষ্টার পরেও তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি মার্কিন সেনাবাহিনীর। আজও সেই জলাজমির মাটিতে পুঁতে রয়েছে সেটি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই গোটা অঞ্চলটি কিনে নেয় মার্কিন সেনা বিভাগ। তারপর পুরু কংক্রিটের আস্তরণে ঢাকা দিয়ে দেওয়া হয় অঞ্চলটি। রালফের হিসেব অনুযায়ী বোমাটির বিস্ফোরক ক্ষমতা ছিল হিরোশিমায় নিক্ষেপিত বোমার প্রায় ২৬০ থেকে ৩০০ গুণ বেশি। অর্থাৎ, তার প্রভাবে নর্থ ক্যারোলিনা তো বটেই, ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেত ফ্লোরিডা, ভার্জিনিয়া, সাউথ ক্যারোলিনা এবং জর্জিয়া। প্রভাব পড়ত নিউ ইয়র্কেও। প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল প্রায় কোটির কাছাকাছি। বলাইবাহুল্য, সামান্যের জন্যই নিস্তার পেয়েছিল মার্কিন প্রদেশ। তবে মাশুল গুনতে হয়েছিল উদ্ধারকর্মীদের। কিছুদিনের মধ্যে প্রায় সকলেই আক্রান্ত হন ক্যানসারে।
তবে গোটা বিষয়টাকেই ধামা চাপা দেওয়া হয় নৈপুণ্যের সঙ্গে। নব্বইয়ের দশকে সাংবাদিক এরিক স্লোসার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেন ব্যক্তিগত একটি গ্রন্থ রচনার জন্য। তখনই প্রকাশ্যে আসে ঘটনাটি। রালফের ডায়েরির কিছু অংশও হাতে পেয়েছিলেন তিনি। তবে তারও বহু পরে, ২০১২ সালে ঘটনার দায় স্বীকার করে মার্কিন প্রশাসন। দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখেই অঞ্চলটির নামকরণ করা হয় ‘নিউক্লিয়ার মিশাপ’।
তবে ‘ব্রোকেন অ্যারো’-ই একমাত্র নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা নয়। শুধু ১৯৫০ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছিল প্রায় ৭০০টি পারমাণবিক দুর্ঘটনা। তার মধ্যে অনেকগুলিরই তথ্য ও নথি নিজের বইতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এরিক। আর বাকিগুলির সামান্য সূত্র। যার বিস্তারিত সমস্ত তথ্যই এখনও গোপন রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ভল্টে।
Powered by Froala Editor