উড়তে চাওয়ার স্বপ্ন সত্যি, আরও সত্যি মাটির নির্মমতা – চেনাল ‘উড়োজাহাজ’

পাখি হোক বা ঘুড়ি, উড়তে দেখলেই ঢিল ছুঁড়ে মাটিতে নামাত পাড়ার ছেলেরা, এই দৃশ্য আমরা অনেকেই ছোটোবেলায় দেখেছি। স্বপ্নকে ভেঙে ফেলতে ঠিক এভাবেই রাষ্ট্রের ওয়াফাদাররা সশস্ত্র এগিয়ে আসে। একটি রাজনৈতিক কিন্তু অরাজনৈতিক সিনেমাতে সেই অসামান্য ভারসাম্য রক্ষা করেছেন পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। সিনেমার নাম ‘উড়োজাহাজ’। দেখে এলাম কয়েকদিন আগে, কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে।

আমার সিনেমাটাকে দেখে একটা চোখ মনে পড়ছে। চোখের এক কোণ থেকে সিনেমার শুরু। আরেক কোণ দিয়ে সমস্ত শরীর চোখ থেকে বেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কত দূরে, কত উঁচুতে। আমি উড়তে চাই, আমি উড়তে চাই। একদিন আমি উড়ব।

https://www.youtube.com/watch?v=7-SKBb2slik

গল্পের শুরু পার্নোর সেই কথা দিয়ে – ‘জানো, আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কত দূর চলে গেছিলাম।’ ঠিক সেখানেই এক পাখা বিক্রেতা ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন পাহাড়ের ধারে। ক্যামেরা পিছু হটছে। জানালার গরাদ আর সেই লোকটির চলে যাওয়া। ক্যামেরা পিছিয়ে এসছে জানলার ভিতর। হ্যাঁ, যেখানে সব স্বপ্ন আটকায়, পাখিরা ডানা ঝাপটে ডাকাডাকি করে একদিন চুপ করে যায়। এই অসামান্য ক্যামেরা মুভমেন্ট। সত্যজিৎ বলতেন, ক্যামেরা কথা বলে। পুরো গল্পটা এখানে যেন ক্যামেরা বলছে। তবে কেউ কেউ বলেছেন যে এই বাঁশিওয়ালার চলে যাওয়া এবং জানলার ভিতর ক্যামেরার পিছিয়ে আসা এ পুরনো ট্রিটমেন্ট। কিছু নতুন নেই। এও শুনেছি, যে প্রপগুলো ছেলেটির ঘর হিসেবে দেখানো, সেগুলো কেমন জানি রিয়্যালিস্টিক নয়। তবে এ প্রসঙ্গে পিটার হানডকের কথা আমার প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তার বক্তব্য যে একটি চেয়ার বা টেবিল যা থিয়েটারে ব্যবহৃত তা থিয়েটারের বাস্তব। আমরা তো এই প্রপগুলোকে সিনেম্যাটিক রিয়্যালটি ভাবতে পারি, সিম্বলিক রিয়েলিজম বলতেই পারি।

যখন ছেলেটি একমনে পরিষ্কার করছে, বিমানটি তখন পিছনে দুটো গাছ এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে। সময়ের এক অসামান্য মেটাফর যা সারা পৃথিবীতে এই প্রথম ব্যবহৃত হল। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নিজের কোনো ছবিতে এই টেকনিক আগে আসেনি। সালভেদর দালির সেই ঘড়ি আর জীবনের ডিমের এক মেটাফর। স্যুররিয়েলিজমের এক অসামান্য প্রয়োগ। সময়কে দালি একমাত্র এভাবে ধরতে পেরেছিলেন।

যুদ্ধের সময় ভেঙে পড়া এক যুদ্ধবিমান জঙ্গলের মধ্যে। ছেলেটা দিনরাত পড়ে থেকে সেই প্লেনটা পরিষ্কার করছে, রং করছে। তার প্লেনের গায়ে আঁকা পাখি, গাছপালা, গাড়ি, মাঠ। এই ছবিটার জন্য একটা ভেঙে পড়া যুদ্ধবিমান চাওয়া হয়েছিল। সরকার দেয়নি। আনন্দ আঢ্যর অসামান্য কাজ। একটি ভাঙাচোরা যুদ্ধবিমানের প্রপ। তার সারা গায়ে এই আঁকা। এটাকে ম্যাজিক রিয়্যালিটি, ম্যাজিক রিয়েলিজম বলা যেতে পারে। ছেলেটির সন্তান বলছে, বাবা ও বাবা একটা মেঘ আঁকো, একটা বৃষ্টি আঁকো। বাচ্চাটার বাবাকে যখন পুলিশ ধরতে এসেছে প্লেন ওড়ানোর চেষ্টা করার অভিযোগে সে দরজা আটকে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি সন্তান স্বপ্ন দেখে বাবার মতো, মায়ের মতো। তাই পুলিশ অফিসার বলে ওঠেন, এই যে গাছ, পাহাড়, সমুদ্র, পাখি, গ্রাম, এটা কী তোর না তোর বাবার ? রাষ্ট্র এগিয়ে আসছে। একজন বাবা, একজন সন্তান পিছোচ্ছে। সরল গলায় তাই সেই বাবা বলতে পারেন, আমাদের পাহাড়, আমাদের গাছ, সরকার তো বাবু আমাদেরই। না না সরকার আমাদের নয়। সরকার রাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ অপ্রকাশিত। কী নীরবে নিভৃতে লেখক মুখোশ রেখে চলে গেলেন।

ছেলেটি থানার সামনে দাঁড়িয়ে। স্যার আপনি বললেই ওরা প্লেনটা এনে দেবে। ক্যামেরা আবার পিছিয়ে আসছে। রাষ্ট্র নজর করছে ক্যামেরাকে। রাষ্ট্র স্বপ্ন বোঝে না তাই ছেলেটা পাগল। সামনে দিয়ে তার কথাগুলো ট্রামে কাটা পড়ছে। জীবনানন্দকে কেউ বোঝেনি বেঁচে থাকার সময়ে। তারকোভস্কির স্যাক্রিফাইস বলা যাবে কি এই সিনেমাকে? দ্য ফ্যান্টম অফ অপেরার একটা কনসেপ্ট যেন গোপনে ছুঁয়ে দিল ছবিকে। সেই থিয়েটারের তলায় ভূতগুলো চাপা পড়ে আছে। ভূত মানে সেই কবরখানা, জীবন, হারানো স্বপ্ন। হ্যাঁ এখানেও সেই উড়োজাহাজের পাশে বসে সেই বাঁচতে না পারা মানুষগুলো। কেউ বা বাঁচতে চেয়েছিল গলায় দড়ি দেবার পর। কেউ নামায়নি ঝুটঝামেলা এড়াবার জন্য। হ্যাঁ বাঁচতে দেওয়া ও আইনশৃঙ্খলার মতি বটে। যে মেয়েটা ভালবাসা পেলো না, যাকেই ভালবাসতে চেয়েছে সেই দূরে সরে গেছে তার মরে যাবার পর ও পরের বার কী সে মনের মানুষ পাবে এই চিন্তা। যে ছাপোষা লোকটা বউ বাচ্চাকে খেতে না দিতে পেরে মেরে ফেলে নিজে মরে গেল, সেও স্বপ্ন দেখে। হ্যাঁ কেন জানি মনে হয় কাফকার ডায়েরি পাতার পর পাতা উল্টোচ্ছে। আর তাই সেই মানুষগুলো যখন নদী পার করে খুঁজতে খুঁজতে উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে তখন মনে হচ্ছিল জীবন একমাত্র স্বপ্নকে অধিকার করে রাখতে পারে না। মৃত্যুর পরও মানুষ স্বপ্ন দেখে। আবার জন্মানোর স্বপ্ন, ভালবাসার স্বপ্ন, ঘর বাঁধার স্বপ্ন। তাই ছেলেটির পাশে বসে একটি চরিত্র বলে ওঠে, বেঁচে থাকতে কী ভাললাগে তাই না। আরেকজন বলেন, আমার জানো কোনো ঘর ছিল না, ফেরার জায়গা ছিল না। যদি এবার হয়। উড়োজাহাজটা যখন নিয়ে চলে গেল রাষ্ট্র তখন এই ফ্যান্টম অফ অপেরা বাধা দিয়েছিল। শোনেনি। তাদের এলিয়ে পড়া দেহের যেন সেদিন সত্যিই মৃত্যু হল।

এদিকে রাষ্ট্রের দাবি ছেলেটা সরকারের সম্পত্তি দখল করছে। উড়োজাহাজ উড়িয়ে কোনো দলের হয়ে সন্ত্রাস ছড়াতে চাইছে। হ্যাঁ রাষ্ট্র এভাবেই ভাবে। তাই হয়তো আমি মনে করি এই ছবিটা নকশাল আন্দোলনের পঞ্চাশ বছরে একটা অ্যাপোক্যালিপ্স। পুলিশের গুলি খেয়ে ছেলেটা আকাশে উড়ে যাচ্ছে। আমি উড়ছি রে, একদিন তোকে আর তোর মা কে নিয়ে উড়ে যাবো। আকাশে উঠছে প্লেন, তার স্বপ্নে নাকি সেই পাখিটা উড়ছে। চোখের কোণ থেকে ছেলেটা উড়ছে। ফ্যানটম অফ অপেরা। রাষ্ট্র থেকে দূরে, মৃত্যু থেকে দূরে। দ্য প্যালেস অফ ড্রিমস তার গন্তব্য।

আমাকে বাঁচতে দাও, ঋত্বিকের সিনেমার সেই হাহাকার যেন আয়না হয়ে উঠেছে এই সিনেমায়। মৃত্যুর পর ও যে সেই বাঁচার আর্তি তা যেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর এইবারের সিগনেচার। ঋত্বিক বলতেন, আমি কেন সিনেমা বানাই? কারণ আমি পাগল। আমি সিনেমা না বানিয়ে থাকতে পারি না তাই। আমার সিনেমার সাবজেক্ট মানুষ, আমার দেশ। আমি তাদের ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবিনা। সে জন্য অন্য দেশের মানুষ আমাকে যদি ত্যাগ করেন আমার যায় আসে না। ঠিক এই সংবেদনশীল মুহূর্তে বুদ্ধদেব বাবু ও কত সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন এ দেশের কষ্ট। রাষ্ট্রের হীনতা, দলে দলে মশা মাছির মতো পাখি নিধন। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কবিতা আছে,
‘পাখির গা যা ছুঁলো, শুধু সেটুকু লিখে ফেলুন।’

সেই অসামান্য নরম রোদের লুকোনো খুনীর চরিত্রকে বার করে এনেছেন লেখক। একটি পলিটিকাল ইয়েট অ্যাপলিটিকাল বেঞ্চমার্ক।

ফাঁকা এরোড্রোম, দূরে নীল পাহাড় আর সুবর্ণরেখা।