আবারও নক্ষত্রপতন সাহিত্যজগতে, প্রয়াত কিংবদন্তি উর্দু কবি শামসুর রহমান ফারুকি


“আব শোর থামা তো ম্যায় নে জানা
আধী কে করীব খো চুকী হৈ”
কবিরা হয়তো এমনই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হন। আগে থেকেই লিখে রাখতে পারেন ভবিষ্যৎ। ঠিক সেভাবেই যেন বর্তমান পরিস্থিতির আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বিশিষ্ট উর্দু কবি, সমালোচক, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, সম্পাদক এবং তাত্ত্বিক শামসুর রহমান ফারুকি। বছর শেষের আগে, বড়োদিনের উৎসবের সন্ধেতেই পাড়ি দিলেন অজানার উদ্দেশে। এ বছর যেন শুধুই বাড়িয়ে চলেছে হারানোর তালিকা। সেই তালিকাতেই এবার যুক্ত হল আরও এক ‘তারা-খসা’র গল্প।
বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। বার্ধক্যজনিত সমস্যা ছিলই। তার ওপরে গত মাসে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন কোভিডে। চলতি মাসের শুরুতে সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও খুব একটা সঙ্গ দিল না শরীর। পাল্লা দিয়েই বেড়েছিল শ্বাসকষ্ট ও আনুষঙ্গিক সমস্যা। শুক্রবার এলাহাবাদের বাড়িতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শামসুর আহমেদ ফারুকির জন্ম ১৯৩৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বর্তমান উত্তরপ্রদেশের আজমগড় শহরে। ছোটো থেকেই সাহিত্য ঘেঁষে বড় হয়ে ওঠা তাঁর। বাড়িতে নিয়মিত চলত গজলচর্চা। পরবর্তীকালে শিক্ষাসূত্রেই আজমগড়ের বদলে তাঁর ঠিকানা হয়ে ওঠে এলাহাবাদ। ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়েশোনা করেন এলাহাবাদ কলেজে।
স্নাতকোত্তরের পর কাজ খোঁজা। আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই অর্থ উপার্জনের চাপ পিছু নিয়েছিল তাঁর। ১৯৬০ সালে ভারতীয় ডাকবিভাগে অল্প টাকার মাইনেতেই শুরু করেন জীবনের লড়াই। পরবর্তীকালে চিফ জেনেরাল পোস্টমাস্টার পদে উন্নতি। ছিলেন পোস্টাল সার্ভিস বোর্ডের স্থায়ী সদস্যও। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সে দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর করেছেন অধ্যাপনাও। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শিক্ষাকেন্দ্রে উর্দু ভাষার সাম্মানিক অধ্যাপক হিসাবে পড়িয়েছেন বেশ কয়েক বছর।
তবে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই চলত তাঁর সাহিত্যচর্চা। পরিবারের থেকে দূরে থাকা যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল কবিতা, শায়রি আর নজমদের প্রতি খিদে। ১৯৬০ সাল থেকেই সাহিত্য পড়ার পাশাপাশি তিনি প্রবেশ করেন লেখালিখির জগতে। কাজ থেকে ফিরে কবিতায় ডুবে যেতেন এক কামরার ঘরে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, এই কবিতাপ্রেমের পিছনে অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে তাঁর স্ত্রীয়েরও।
তবে শুধু লেখালিখি করলেই তো আর চলে না। আরও পাঁচজন সমসাময়িক পছন্দের লেখকদের লেখাকেও তো সামনে আনতে হয়। সাধারণ পাঠকদের পরিচয় করাতে হয় সেসব লেখা, লেখকদের সঙ্গে। একজন দায়িত্বশীল লেখকের সেই দায়টাও থেকে যায় হয়তো। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে শুরু করেন উর্দু সাহিত্য পত্রিকা ‘শাবখুন’। ছ’য়ের দশক থেকে শুরু করে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবেই সেই পত্রিকার সম্পাদনা করে গেছেন শামসুর রহমান ফারুকি। অক্লান্তভাবে। তবে অসুস্থতার কারণেই শেষ বয়সে এসে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল সেই কর্মযজ্ঞ থেকে।
লিখেছেন ৫০টিরও বেশি কবিতা, গদ্য, অনুবাদ এবং বিশ্লেষণাত্মক বই। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আসমান মেহরাব’, ‘আনদাজ-ই গুফতগু ক্যায়া হৈ’, ‘আকবর এলাহাবাদি’, ‘কাহি চান্দ থে সার-এ আসমান’, ‘দ্য মিরর অফ বিউটি’ ইত্যাদি। তবে সাহিত্যসৃষ্টির থেকেও উল্লেখযোগ্য তাঁর উর্দু ভাষার ওপর বিভিন্ন কাজ। উর্দু ভাষার বিবর্তনের অলিখিত ইতিহাস নিয়েই বিস্তারিত গবেষণা করেছেন শামসুর রহমান ফারুকি। যা উর্দু সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। মোঘল আমলে কথিত উর্দু ভাষার রূপকে নতুন করে বর্তমানের সাহিত্যচর্চার অঙ্গ করে তুলেছিলেন তিনি। তাছাড়াও ষোড়শ শতকের হারিয়ে যাওয়া উর্দু ভাষার মৌখিক ভাবে প্রচলিত লোকসংস্কৃতি ও গল্পের ধারা ‘দাস্তানগোই’-এরও পুনর্জন্ম দেন শামসুর রহমান। পাশাপাশি গালিব, মির তাকি মির, ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ প্রমুখ কবির উল্লেখযোগ্য উর্দু সাহিত্যরচনার ইংরাজি অনুবাদ হয় তাঁর হাত ধরেই। তাঁর দৌলতেই উর্দু সাহিত্য হয়ে হয়ে সর্বজনগৃহীত।
১৯৯৬ সালে পেয়েছেন সরস্বতী সম্মান। ২০০৯ সালে উর্দু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য সম্মানিত হয়েছেন পদ্মশ্রীতেও। এছাড়াও পুরস্কারের তালিকা শুরু করলে তা শেষ হওয়ার নয়। তবে এসব পুরস্কারের কাছে খানিকটা নির্লিপ্তই থেকেছেন তিনি চিরকাল। দিন কাটাতে চেয়েছিলেন বইয়ের সঙ্গেই, সাহিত্যের মধ্যে। চেয়েছিলেন উর্দু সাহিত্যচর্চার একটা পরিবেশ গড়ে তুলতে। সেখানে যে একশো শতাংশ সফল হয়েছেন তিনি, তাতে সন্দেহ নেই কোনো।
“বানায়েঙ্গে নয়ি দুনিয়া হাম আপনী
তিরী দুনিয়া মেঁ আব রেহনা নহীঁ হৈ”
সমস্ত কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নিজের সেই স্বপ্নের পৃথিবী তৈরিতেই পাড়ি দিলেন যেন তিনি। আর একটা যুগ যেন শেষ হয়ে গেল নিশ্চুপেই। সকলের আড়ালে। শুধু দেখিয়ে গেলেন উর্দু ভাষায় রচিত সাহিত্যরা স্রেফ অবহেলাতেই পড়ে রয়েছে পাঠকের অপেক্ষায়...

Powered by Froala Editor

Latest News See More