সময় কখনও সরলরেখায় এগোয় না। নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত হতে হতেও বাঁচিয়ে রাখতে হয় প্রেম, ভালোবাসা। প্রত্যেকটা সময়ে যেন এই কথাটাই মনে করিয়ে দিতে আসেন শিল্পীরা। আর পাথরে ফুল ফোটানোর কথাই যদি বলা হয়, তাহলে সাম্প্রতিক সময়ের হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই অবশ্যই নাম আসবে কবি রাহাত ইন্দোরির। নাগরিকপঞ্জি বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনের মঞ্চ থেকে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি, প্রতিটা জায়গাতেই যেন বর্তমান সময়কে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আর তার সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন একটা ভেদাভেদমুক্ত ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব স্বপ্ন ক্রম-পরিণতির দিকে এগোবে কিনা জানা নেই। কিন্তু কবির নিজের চোখে আর সেই দিন দেখে যাওয়া সম্ভব হল না। অজস্র না বলা কথা বাকি রেখে মঙ্গলবার বিকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রাহাত ইন্দোরি।
গত রবিবার স্থানীয় একটি নার্সিং হোম থেকে শ্রী অরবিন্দ হসপিটালে ভর্তি করা হয় কবি রাহাতকে। এরপর হঠাৎ অবস্থার অবনতি হতে থাকে। প্রথম হার্ট অ্যাটাকের ধাক্কা সামলে উঠলেও মঙ্গলবার পরপর দুটি অ্যাটাকের ধাক্কা সামলাতে পারলেন না তিনি। চিকিৎসকদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে মারা গিয়েছেন তিনি। তাঁর চিকিৎসক ডা. বিনোদ ভাণ্ডারি জানিয়েছেন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে তাঁর ফুসফুসের ৬০ শতাংশই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। ফলে সুস্থ হয়ে ওঠার কোনো আশাই ছিল না।
১৯৫০ সালে ইন্দোর শহরের এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম রাহাত কুরেশির। তাঁর বাবা ছিলেন একটি ছোট বস্ত্রশিল্প কারখানার শ্রমিক। কিন্তু দারিদ্রের সঙ্গে প্রতি মুহূর্ত লড়াই চালিয়েও শিল্পবোধকে হারিয়ে ফেলেননি তিনি। আর সেইসঙ্গে উর্দু ভাষার প্রতি ছিল এক অদ্ভুত টান। এই দেশের অজস্র সাধারণ মানুষের ভাষা উর্দু, অথচ তাকে নানা সময় কেমন বিদেশি চরিত্র মনে করা হয়েছে। এই ধারণাটার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন রাহাত কুরেশি, থুরি, তখন তিনি প্রতিষ্ঠিত কবি রাহাত ইন্দোরি।
প্রায় চার দশক ধরে অসংখ্য কবিতা ও গানে দেশের মানুষের মনোরঞ্জন করে এসেছেন তিনি। তাঁর গানের, কবিতার ব্যঞ্জনায় উর্দু ভাষাকেও আপন করে নিয়েছেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে যেমন সেই ভাষার ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসের কথা বলতেন, তেমনই জীবনের প্রেমের অনুভূতিকে মিলিয়ে দিতেন কবিতার কথায়। ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’, ‘মিশন কাশ্মীর’, ‘ইশক’ প্রভৃতি সিনেমার গানও সমস্ত দেশের মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। অনেকেই হয়তো জানেন না, গানের একেকটি কথার জন্ম কবি রাহাতের কলমে।
সেই সৌন্দর্যের কবিকেই আবার আমরা কিছুদিন আগে দেখেছি নাগরিকপঞ্জি বিরোধী আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে। শাহিনবাগে প্রতিবাদী জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে গাইছেন তাঁর ৩৫ বছর আগে লেখা একটি গজল। “সবহি কা খুন হ্যায় সামিল ইয়াহাঁ কি মিট্টি মে, কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়”। ৭০ বছর বয়সে এসেও সামাজিক অচলাবস্থায় বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ক্লান্ত দেখা যায়নি কবিকে। হয়তো শিল্পী-সাহিত্যিকদের দায়িত্বই তাই। আজ আর সশরীরে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবেন না কবি রাহাত। কিন্তু তাঁর প্রতিটা কবিতা থেকে যাবে। মানুষের হাত ধরে এগিয়ে যাবে এই দুঃসময়কে পিছনে ফেলে। কবি হয়তো সেই সময়ে কথা ভেবেই লিখেছিলেন, “অব সে রোজ মুলাকাত কি উমিদ নেহি, অব কাঁহা শহর মে রহতে হ্যায় ঠিকানা মেরি”।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্রয়াত সমাজকর্মী এবং লেখিকা ইলিনা সেন, থেমে গেল বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠ