চোখের কোনে টানা কাজল, নাকে বিরাট নথ অথবা হাতে বড়ো বড়ো আংটি। যে চেহারায় তাঁকে আমরা দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি, তা যেন আর পাঁচজনের সঙ্গে মেলে না। তিনি ব্যতিক্রম। শুধুই নিজের সাজ-পোশাকে নয়, বাঙালির ফ্যাশন সম্বন্ধে ধারণাটাই তো বদলে দিয়েছিলেন। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়া শর্বরী দত্ত। যিনি বাঙালিকে বুঝতে শিখিয়েছেন পুরুষেরও শৌখিন পোশাক সম্ভব। যে পুরুষের সাজতে ভালো লাগে তিনি ‘মেয়েলি’ নন; তিনি শৌখিন। আজ আর শর্বরী দত্ত নেই। শুধু থেকে গিয়েছে তাঁর অসংখ্য কাজ এবং এক হার না মানা নারীর জীবনের গল্প।
২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউর বাড়িটা থেকেই অন্য একটা কিছু করার। বাড়িটা রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি অজিত দত্তের। সমকালের সমস্ত কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর আড্ডার জায়গা ছিল এই বাড়িটি। কিন্তু সেখানে সেই ছোট্ট কৃষ্ণবর্ণা ঝুমাই যে একদিন বাড়ির সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে উঠবেন, সেকথা কি সত্যিই কেউ ভাবতে পেরেছিলেন? হয়তো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এভাবে ভাবতেই শেখায়নি আমাদের।
সেদিনের সেই ছোট্ট ঝুমাই পরবর্তীকালের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব শর্বরী দত্ত। তাঁর নামের আগে বসে একটি বিশেষণ; ফ্যাশান ডিজাইনার। রুচিশীল সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে জন্ম তাঁর। যদিও সে সময় বাঙালিদের মধ্যে ফ্যাশান ডিজাইনিং সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না। তবে বাঙালি মেয়ে হাতের কাজ শিখবে, এতে আশ্চর্যের কী আছে? সেই থেকেই শুরু সেলাই-ফোঁড়াই আর ছবি আঁকা। তবে সেখান থেকে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার রাস্তাটা ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভর্তি।
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার পর শর্বরী ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর তখনই বিয়ে হয়ে গেল ছোট্ট ঝুমার। বয়স তখনও কুড়ির কোঠা পার করেনি। এর মধ্যেই কাঁধে এসে পড়ল সংসারের দায়িত্ব। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর, ননদ নিয়ে বড়ো যৌথ পরিবার। ক্রমশ ঘরকন্নায় বন্দি হয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু মুক্তির আশা মনের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠত প্রায়ই।
মুক্তির প্রথম সুযোগ এল ১৯৬৯ সালে। তবে ডিজাইনিং নয়। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমায় নায়িকা চরিত্রের জন্য তাঁকেই বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু শর্বরী তখন নেপালে স্বামীর সঙ্গে ধসে আটকা পড়ে গিয়েছেন। তাঁর কাছে এই খবর যখন পৌঁছয় তখন শ্যুটিং-এর ব্যস্ততার জন্য অন্য তালিকা তৈরি করে ফেলেছেন সত্যজিৎ।
সুখের সংসারে অশান্তির বীজ বাসা বাঁধল খুব তাড়াতাড়ি। শর্বরী নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। পুরুষের সঙ্গে একই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চান। কিন্তু তাঁর স্বামী পর্দাপ্রথাতেই বিশ্বাসী। শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিলেন শর্বরী। একটা বেসরকারি সংস্থায় কপিরাইটারের কাজ শুরু করেন। সে কাজ অবশ্য বেশিদিন টেকেনি, কিন্তু তাঁর ডিজাইন দেখে মুগ্ধ হয়ে এক সহকর্মী বলেছিলেন, অন্যার কাছে চাকরি খোঁজার প্রয়োজন নেই শর্বরীর। তিনি নিজেই অনেককে চাকরি দিতে পারেন। এই একটি কথাই তাঁর জীবন বদলে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন
প্রয়াত বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার শর্বরী দত্ত, বাকি রয়ে গেল তাঁর ‘অধ্যাপনা’
১৯৯১ সালে প্রথম প্রদর্শনী নিয়ে হাজির শর্বরী দত্ত। প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু ‘পুরনো কলকাতা ও সাহেব, বাবু, বাঈজি কালচার। এবার গোটা শহরের হোঁচট খাওয়ার পালা। শর্বরী ভেবেছিলেন, ধুতির রং কেন শুধু সাদার শেডে হবে? রঙিন প্যান্ট পরতে পারলে রঙিন ধুতিও পরা যাবে নিশ্চই। কিন্তু বাধা ছিল সমাজের মানসিকতায়। তাই সেই প্রদর্শনীতে অন্য অনেক পোশাক বিক্রি হলেও একটিও রঙিন ধুতি বিক্রি হল না। ১৯৯২ সালে আবার প্রদর্শনীতে হাজির হলেন শর্বরী দত্ত। প্রদর্শনী উদ্বোধন করলেন অপর্ণা সেন। তখন সবে তাঁর সিনেমা ‘শ্বেতপাথরের থালা’ মুক্তি পেয়েছে। সেই সিনেমার নায়ক দীপঙ্কর দত্তই হলেন শর্বরীর মডেল। এবার কিন্তু সাফল্যের মুখ দেখল তাঁর প্রদর্শনী।
১৯৯৩ সালে তৃতীয় প্রদর্শনীর ঠিকানা ছিল মুম্বই। বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। আর সেইসঙ্গে বাঙালি জীবনে শুরু হল নতুন একটি রেওয়াজ। বিশেষ করে পুজোর পোশাকে রঙিন ধুতি এখন সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এ সবই হয়েছে শর্বরীর ডিজাইনের দৌলতেই। শুধু যে রীতিতে পরিবর্তন এল তাই নয়। তাঁর ডিজাইনে মুগ্ধ হলেন সেলিব্রেটিরাও। টলি ও বলি জগতের তারকারা তো বটেই, তাঁর ডিজাইন করা পোশাক পড়েছেন মকবুল ফিদা হোসেন থেকে কপিল দেব, সৌরভ গাঙ্গুলি, সচিন তেন্ডুলকর সকলেই। অভিষেক বচ্চনের বিয়ের পোশাকও তাঁর ডিজাইন করা। এমনকি ঋতুপর্ণ ঘোষও শর্বরীকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁর সিনেমা ‘অন্তরমহল’-এর জন্য।
তবু শেষ বয়সেও লড়াই ছাড়েননি শর্বরী দত্ত। প্রথম থেকে তিনি শুধু ডিজাইনের দিকটাই দেখতেন। ব্যবসা সামলাতেন তাঁর ছেলে এবং পুত্রবধূ। কিন্তু ছেলের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে শেষে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হলেন শর্বরী। পরবর্তীকালে রেশমি বাগচীর সঙ্গে যৌথভাবে জড়িয়ে পড়লেন ‘শূন্য’-র সঙ্গে। নতুন উড়ান পেল তাঁর ডিজাইনিং। এভাবেই বারবার নতুন-নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে তাঁর শিল্পবোধ। না, স্বামী বা পুত্র - পুরুষের ক্রীড়নক হয়ে তিনি থাকেননি কোনোদিনই। সে-কারণেই তিনি অদ্বিতীয়া...
আরও পড়ুন
সিনেমায় চশমা-পরা ব্যোমকেশ, সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ দেখে অখুশি শরদিন্দু
তথ্য ঋণ -
১। ‘রাসবিহারী থেকে ব্রড স্ট্রিটে গিয়ে ক্রমশ ব্র্যান্ড হয়ে উঠলেন শর্বরী দত্ত’ – ঋজু বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা
২। ‘পুরুষদেরও যে ফ্যাশন হতে পারে, তা শিখিয়েছিলেন শর্বরী দত্ত’, নিউজ১৮
আরও পড়ুন
দৃষ্টিহীন বিনোদবিহারীকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানালেন সত্যজিৎ, ক্যামেরার পিছনে সৌমেন্দু রায়
৩। ‘শুধু ফ্যাশন সম্রাজ্ঞী নন, শর্বরী দত্ত নায়িকা হওয়ারও সুযোগ পেয়েছিলেন সত্যজিত রায়ের ছবিতে’ – শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্য ওয়াল
Powered by Froala Editor