বাংলা ছাপাখানার একেবারে শুরুর দিকে শ্রীরামপুর মিশন থেকে দুটি বই ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল— কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর কাশীদাসী মহাভারত। এ দুটি হল প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে রামায়ণ ও মহাভারতের জনপ্রিয়তম ভাবানুবাদ। এরপর দিন গড়াল, একের পর এক আধুনিক বাঙালি সাহিত্যরসিকেরা মহাকাব্য অনুবাদের চেষ্টায় লাগলেন। মধ্যযুগের অনুবাদ থেকে এঁদের অনুবাদে দুটি মূল তফাত দেখা গেল— পদ্যের বদলে গদ্যভাষার প্রাধান্য, আর নিজস্বতার বদলে যথাসম্ভব মূলানুগত্য। এঁদের মধ্যে একদল আবার ভাবলেন, মহাকাব্যের স্বাদ থেকে শিশুরাই বা বঞ্চিত থাকবে কেন? তাদের জন্য, তাদের মনের মতো করে কিছু লেখা হোক! এই শিশুতোষ অনুবাদক-দলের অগ্রপথিক হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (Upendrakishore Ray Chowdhury)।
বাল্মীকি রামায়ণ (Ramayana) ও বৈয়াসকী মহাভারতের (Mahabharata) নির্যাস শিশুপাঠের উপযোগী করে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর রচনা-সম্ভারে, রামায়ণ-মহাভারতের সামগ্রিক অনুবাদ-নির্ভর বই তিনটি— পদ্যে লেখা 'ছোট্ট রামায়ণ', এবং গদ্যে লেখা 'ছেলেদের রামায়ণ' আর 'ছেলেদের মহাভারত'। এইখানে গ্রন্থ-শিরোনামে ‘ছেলে’ শব্দটি উভলিঙ্গ, শিশু অর্থে ব্যবহৃত। আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো, পদ্য ও গদ্য দুই অনুবাদেই উপেন্দ্রকিশোর উত্তরকাণ্ড বাদ রেখে রামায়ণ-বৃত্তান্ত ছয় কাণ্ডে সমাপ্ত করেছেন, রামের রাজ্যাভিষেকের আনন্দই তাঁর অনুবাদে রামায়ণের চূড়ান্ত ঘটনা।
এছাড়া, 'পুরাণের গল্প' বইতে তিনি রামায়ণ থেকে সংগৃহীত কিছু কাহিনি পরিবেশন করেছেন, যেমন— 'প্রথম কবি ও প্রথম কাব্য', 'হনুমানের বাল্যকাল', 'রাবণ' এবং 'শব্দবেধী'। মহাভারত থেকে চয়ন করা কিছু কাহিনিও এই বইতে পাওয়া যাচ্ছে, যেমন— 'গরুড়ের কথা', 'জরৎকারুর কথা' ইত্যাদি। 'মহাভারতের কথা' বইয়ের আগাগোড়া সবকটি গল্পেরই উৎস বৈয়াসকী মহাভারত।
উপেন্দ্রকিশোরের রচনার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি রাম কিংবা কৃষ্ণের ভগবত্তা বিষয়টি নিয়ে বিশেষ সরব হননি, কৃষ্ণের ক্ষেত্রে তাও যা বলেছেন, রামের ক্ষেত্রে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ নীরব। 'ছেলেদের রামায়ণ' বইয়ের রাম নরচন্দ্রমা, শ্রেষ্ঠ মানব; কিন্তু তিনি যে বিষ্ণুর অবতার কিংবা পরমেশ্বর ভগবান— এমন কোনো বক্তব্য উপেন্দ্রকিশোর অনুবাদে স্থান দেননি। 'ছোট্ট রামায়ণ' বইয়ের আদিকাণ্ডে শাপিত অহল্যা সম্পর্কে বিশ্বামিত্রের বচন ‘দেবী ভাবেন হরি হেথায় পড়ি/ দারুণ সাজা সয়ে’ এবং তারপরেই রামের দর্শনে অহল্যার শাপমুক্তি— এইখানে রাম ও হরি-বিষ্ণুর ঐক্যের একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত কবি রেখে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন
‘স্কল’, ‘স্কেলিটন’ কিংবা মজলিশি ভূতেরা – ত্রৈলোক্যনাথ থেকে উপেন্দ্রকিশোর
'ছেলেদের মহাভারত' বইতে উপেন্দ্রকিশোর কৃষ্ণের ঐশী বৈভবের উল্লেখ বারেবারে স্তিমিত করেছেন, যেমন— সভাপর্বে দ্রৌপদী রক্ষা পেলেন ‘দেবতার কৃপায়’, তাঁর কৃষ্ণস্তব বাদ পড়েছে। উদ্যোগপর্বে কৌরবসভায় কৃষ্ণের ঐশ্বরিক শক্তিমত্তা প্রদর্শনের কাহিনি বাদ পড়ল, তাঁর ‘চেহারা দেখিয়া’-ই প্রতিপক্ষ ভয় পেয়ে গেল, এবং তিনি কেবল ‘ধমকের চোটে’ তাদের জব্দ করে দিলেন। ভীষ্মপর্বে ভগবদগীতার উপদেশ দেওয়ার সময়ে বিশ্বরূপ প্রদর্শন বিষয়ে লেখক পুরোপুরি নীরব।
আরও পড়ুন
উপেন্দ্রকিশোরের আবিষ্কার ভাঙিয়ে অনেকেই লাখপতি হয়ে উঠলেন বিলেতে
তবে মাঝেমাঝে কৃষ্ণের ভগবত্তার কথা তিনি অল্পস্বল্প উল্লেখও করেছেন। বনপর্বে দুর্বাসার শাপভয়ে ভীত দ্রৌপদী কৃষ্ণকে স্মরণ করতেই তিনি আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হলেন, এই ঘটনার ব্যাখ্যায় উপেন্দ্রকিশোরকে লিখতে হয়েছে, ‘কৃষ্ণ সাধারণ মানুষ নহেন, তিনি দেবতা।’ ভীষ্মপর্বে ক্রুদ্ধ কৃষ্ণের উদ্দেশে ভীষ্মের স্তব ‘তুমি সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ’, কিংবা দ্রোণপর্বে ভগদত্তের বৈষ্ণবাস্ত্র প্রশমনের সময় স্বয়ং লেখকের উল্লেখ ‘কৃষ্ণ (যিনি নিজেই বিষ্ণু)’— এই অংশগুলিতে দেখা গিয়েছে, কৃষ্ণ কেবল এক শ্রেষ্ঠ মানব মাত্র নন, তিনি দেবতা, তিনি দেবশ্রেষ্ঠ, তিনি স্বয়ং বিষ্ণু।
আরও পড়ুন
ক্যামেরার জন্য বিশেষ ইন্ডিকেটর বানালেন উপেন্দ্রকিশোর, বদলে গেল ছবি তোলার দৃষ্টিভঙ্গিও
উপেন্দ্রকিশোরের অনুবাদ যেহেতু শিশুতোষ ভাবানুবাদ, তাই স্বভাবতই তাদের পক্ষে অবোধ্য ও অস্বস্তিকর যৌন প্রসঙ্গ সেই অনুবাদ থেকে হয় বাদ গেছে, নয়তো ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে পরিবেশিত হয়েছে। রামায়ণ আর মহাভারত, দুই ক্ষেত্রেই আমরা এইরকম অনেক উদাহরণ দেখতে পাব।
‘প্রথম কবি ও প্রথম কাব্য’ গল্পে তমসার তীরে বাল্মীকির সম্মুখে ক্রৌঞ্চযুগলের রতিক্রীড়াকে উপেন্দ্রকিশোর ‘খেলা’ শব্দ দিয়ে আড়াল করে লিখেছেন, “সেইখানে দুটি বক নদীর ধারে খেলা করিতেছিল।” এই অনুচ্ছেদেই ‘খেলা’ শব্দ আরও দুইবার ব্যবহৃত হয়েছে। তারপর ব্যাধের আগমন, একটি বিহঙ্গের প্রাণনাশ এবং বাল্মীকির মুখ থেকে শাপবাক্য নিঃসরণ। দেবভাষায় এই শাপ-শ্লোক ছিল— ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।’ উপেন্দ্রকিশোর ভাবানুবাদে এই কাম-মোহ সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়েছে, এবং আবার এসে হাজির হয়েছে ‘খেলা’। উপেন্দ্রকিশোরের বাল্মীকি উচ্চারণ করেছেন, “ওরে ব্যাধ, এমন সুখে পাখিটি খেলা করিতেছিল, তাহাকে তুই বধ করিলি? তোর কখনই ভালো হইবে না!”
আদিকাণ্ডের অহল্যা-বৃত্তান্ত বলার সময়েও, স্বভাবতই অহল্যার ইন্দ্রসঙ্গমের প্রসঙ্গটি উপেন্দ্রকিশোরের অনুবাদে অদৃশ্য হয়েছে। ‘ছোট্ট রামায়ণ’ বইতে বিশ্বামিত্র গৌতমের ক্রোধের কারণ হিসাবে বলেছেন, ‘জায়া অহল্যারে শাপেন তিনি/ বিষম দোষের তরে।’ ছেলেদের রামায়ণ বইতেও একই ব্যাপার, বিশ্বামিত্র বলছেন, ‘গৌতমের স্ত্রী অহল্যা একবার একটা নিতান্ত অপরাধের কাজ করাতে গৌতম তাঁহাকে এই বলিয়া শাপ দিয়াছিলেন…’। একইরকমভাবে, অরণ্যকাণ্ডে সীতা কর্তৃক লক্ষ্মণকে তিরস্কার, সুন্দরকাণ্ডে সীতার প্রতি রাবণের কামজর্জর বাক্যপ্রয়োগ কিংবা লঙ্কাকাণ্ডে রামের সীতা-প্রত্যাখ্যান— সমস্ত ক্ষেত্রেই উপেন্দ্রকিশোর অস্বস্তিকর অংশগুলি হয় ছেঁটে বাদ দিয়েছেন, নয়তো অন্য শব্দের আড়ালে আবৃত করে দিয়েছেন।
এইবার মহাভারত থেকে কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক। অভিজ্ঞ পাঠক জানেন, কিন্দম মুনির শাপে পাণ্ডু স্ত্রীসঙ্গমে অপারগ হন, তাই তাঁর স্ত্রী কুন্তী দুর্বাসা মুনির শেখানো মন্ত্রে দেবতাদের তুষ্ট করে তাঁদের মাধ্যমে নিজে তিনটি সন্তান লাভ করেন, এবং মাদ্রীকেও দুটি সন্তানের জননী হওয়ার সুযোগ দেন। আদিপর্বে এই ঘটনাকে শিশুতোষ আকার দিয়ে উপেন্দ্রকিশোর লিখছেন, ‘এক-একজন দেবতা পাণ্ডুকে এইসকল পুত্রের এক-একটি দিয়াছিলেন। … সেইজন্য লোকে বলে যে, যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র, ভীম পবনের পুত্র, অর্জুন ইন্দ্রের পুত্র, নকুল সহদেব অশ্বিনীকুমারদিগের পুত্র।’ কুন্তী কুমারীকালে হঠকারিতার বশে এই মন্ত্রে সূর্যকে আহ্বান করে কর্ণের জন্ম দিয়েছিলেন, এবং সামাজিক সম্মান রক্ষার জন্য শিশুটিকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই ঘটনার অস্বস্তিকর অংশ কাটছাঁট করে উপেন্দ্রকিশোর আদিপর্বে লিখেছেন, ‘কুন্তী কর্ণের মা হইয়াও তাঁহার প্রতি মায়ের কাজ করেন নাই, জন্মিবার পরেই তিনি তাঁহাকে ফেলিয়া দেন।’ পরেও উদ্যোগপর্ব, ভীষ্মপর্ব, স্ত্রীপর্ব প্রভৃতিতে বারংবার কর্ণের কুন্তী-পুত্রত্বের প্রসঙ্গ এসেছে, কিন্তু কখনওই তার বিশদ ব্যাখ্যা উপেন্দ্রকিশোর জানাননি।
দ্রৌপদীর প্রতি বিভিন্ন পুরুষের সকাম মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রেও উপেন্দ্রকিশোর একইভাবে রেখেঢেকে কথা বলার নীতি নিয়েছেন। আদিপর্বে অর্জুনের বনবাসের কারণ ছিল, তিনি নির্জন অস্ত্রাগারে যুধিষ্ঠির এবং দ্রৌপদীর রতিবিলাসের সময় সেখানে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই ঘটনাকে উপেন্দ্রকিশোর লিখলেন, ‘…অস্ত্রের ঘরে দ্রৌপদী আর যুধিষ্ঠির কথাবার্তা কহিতেছেন।’ রতিক্রীড়া বদলে গিয়ে হল ‘কথাবার্তা’। সভাপর্বে, দুর্যোধন নিজের বস্ত্র সরিয়ে দ্রৌপদীকে নিজের বাম ঊরু প্রদর্শন করেছিলেন, এর মধ্যে একেবারে প্রকটভাবে যৌন সঙ্গমের অশালীন আহ্বান ছিল। এই অভব্যতা উপেন্দ্রকিশোরের কলমে স্তিমিত হল, তিনি লিখলেন, ‘…তখন (দুর্যোধন) হাসিতে হাসিতে আবার দ্রৌপদীকে পা দেখাইলেন…’। রতিক্রীড়ার অশালীন আহ্বান বদলে গিয়ে হয়ে গেল, সম্মাননীয় ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধেয় আচরণ। বিরাটপর্বে সৈরিন্ধ্রীর ছদ্মবেশে থাকা দ্রৌপদীর প্রতি রাজশ্যালক কীচকের কামাতুর আচরণকে উপেন্দ্রকিশোর বারে বারে ‘অপমান’, ‘অভব্যতা’ ইত্যাদি শব্দের আড়ালে ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এবার আসা যাক, অনুবাদের ভাষাশৈলীর বিশিষ্টতার প্রসঙ্গে।
আদ্যন্ত সাধুভাষায় লেখা হলেও, উপেন্দ্রকিশোরের গদ্যভাষা এতই লঘু, সরল আর সতেজ যে, শিশুদের তা পড়তে এবং রসগ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। এই সারল্য ‘ছোট্ট রামায়ণ’ বইতে আরও বেশি প্রকট। আদিপর্বে তাড়কা রাক্ষসীর আক্রমণের বিবরণ, ‘হাঁই-মাঁই-কাঁই’ করি ধাঁই-ধাঁই ধায়,/ হুড়মুড়ি ঝোপঝাড় চুরমারি পায়।/ গরজি-গরজি বুড়ি ছোটে, যেন ঝড়,/ শ্বাস বয় ঘোরতর ঘড়র-ঘড়র। কান যেন কুলো তার, দাঁত যেন মুলো।/ জ্বল-জ্বল দুই চোখ জ্বলে যেন চুলো।/ হাঁ করেছে দশ গজ, তাহে জিভ খান/ লকলকে চকচকে, দেখে ওড়ে প্রাণ।’ একেবারে কথ্য বাংলায় লেখা এই বিবরণে তাড়কা আর মহাকাব্যিক বীভৎসতা হারিয়ে হয়ে উঠেছে বাংলার রূপকথার রাক্ষসী, যার বিবরণে ভয়ের পাশাপাশি মিশে আছে কৌতুক। অযোধ্যাকাণ্ডে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে ভরতের সেনাবাহিনীর ভোজনবিলাসের বর্ণনাতেও আমরা পাচ্ছি বাঙালি খাদ্যাভ্যাসের স্বাদ— ‘ঘোল, চিনি, ক্ষীর, সর, দধি, মালপুয়া,/ রাবড়ি, পায়স, পিঠা, পুরী, পানতুয়া।’
এইভাবেই উপেন্দ্রকিশোর বাংলার শিশুদের পাতে তুলে দেবার আগে, মহাকাব্যকে বাঙালিয়ানার রসে জারিয়ে নিয়েছেন।
Powered by Froala Editor