রঙিন ছবির হাফটোন প্রতিচ্ছবি ছাপার জন্য হয় গোলাকার, নয়তো দুটি আয়তাকার গ্লাস স্ক্রিন ব্যবহার করে তিনটি নেগেটিভ তৈরি করে নিতে হয়। উপেন্দ্রকিশোর প্রথম প্রমাণ করলেন যে, একটিমাত্র আয়তাকার ৬০ ডিগ্রি স্ক্রিন ব্যবহার করেই (বিশেষভাবে প্রস্তুত কয়েকটি ডায়াফ্রামের সাহায্যে) থ্রি কালার হাফটোন ছবি ছবি ছাপার উপযোগী তিনটি হাফটোন নেগেটিভ প্রস্তুত করা সম্ভব। এই ধরনের রঙিন ছবিতে যে লাইন-এফেক্ট পাওয়া যায় তা ক্ষেত্রবিশেষে অতি সন্তোষজনক। প্রসেস ক্যামেরার কর্মপদ্ধতির উন্নতি সাধনে উপেন্দ্রকিশোরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান মালটিপ্ল স্টপ। উপেন্দ্রকিশোরের প্রস্তাবগুলির পরিচয় দেওয়ার আগে জেনে নেওয়া দরকার সে-সময়ে কী ধরনের স্টপ ব্যবহার করা হত (আজও তাই হয়) এবং সেই সাধারণ স্টপ-এর (সিঙ্গল স্টপ-এর) কার্যপ্রণালী ছিল কী ধরনের।
হাফটোনের কাজে নানা ধরনের আকৃতির স্টপ ব্যবহার করা হত, কিন্তু ডায়াফ্রাম পাতের মধ্যে ছিদ্র থাকত একটিই। (তাই এগুলিকে উপেন্দ্রকিশোর ‘সিঙ্গল স্টপ’ আখ্যা দিয়েছিলেন)। চৌকো আকৃতির স্টপ ব্যবহার করলে পাওয়া যায় চৌকো ডট্। কিন্তু এই চৌকো স্টপটির বাহুগুলি যদি স্ক্রিন-লাইনের সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রি কোণে স্থাপিত হয় (রুইতনের ফোঁটার মতো) তাহলে ডটের চেহারাটা হয় প্রায় আটকোণা ক্ষেত্রের মতো, কারণ স্ক্রিনের লাইন চৌকো স্টপের কোণগুলিকে ছেঁটে ফেলে। কিন্তু এই স্টপের কোণগুলি যদি কেটে বাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে ডটগুলি ওই কোণাগুলি বরাবর ছড়িয়ে পড়বে। এই ছড়িয়ে পড়াকেই সাধারণত ‘জয়েনিং আপ’ বলা হয় এবং প্রসেস কর্মীরা এই ঘটনাটিকে স্বাগত জানায়। কারণ এর ফলে হাইলাইট অংশের সাপেক্ষে নেগেটিভের ডটগুলি আংশিক ভাবে একে অন্যের ওপর এসে পড়ে (overlap) এবং দাবা বোর্ডের মতো বাঞ্ছিত নকশা গঠন করে। ভেরফাসারের লেখা থেকে জানা যায় চৌকো স্টপ, বর্ধিত কোনাসমেত চৌকো (square stop with extended corners) ছাড়াও ক্রস চিহ্নের, তারার বা পিনকুশনের আকৃতির স্টপও ব্যবহার হতো, কিন্তু এসবের কার্যকরতা সম্বন্ধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সন্দিগ্ধ। এবং বর্ধিত কোনা সমেত চৌকো স্টপ ছাড়া আর কোনো আকৃতির স্টপের বিষয়েই একটি ছত্র বর্ণনা করেননি।
এবার দেখা যাক ভেরফাসার এইসব সিঙ্গল স্টপ ব্যবহারের প্রণালী সম্বন্ধে কী জানিয়েছিলেন। সাধারণত ফোটোগ্রাফ তোলার মতো শুধু যদি একটি মাপের (size) ডায়াফ্রাম ব্যবহার করে এক্সপোজার দেওয়া হয়, তাহলে শ্যাডো অংশে ডটগুলি গঠিত হওয়ার আগেই নেগেটিভের হাইলাইট অংশ পুরোপুরি গঠিত হয়ে যায়। মিড্ল টোন অংশের ডট্গুলিও অসম্পূর্ণ থাকে। তাই সাধারণ পদ্ধতি হল শ্যাডো অংশে জোর করে ডট ফুটিয়ে তোলা। এটা করার জন্য খুব ছোটো মাপের একটা গোলাকার ডায়াফ্রামের সাহায্য নেওয়া হয়—এই ধরা যাক f/64 মাপের বা তারও ছোটো। এই স্টপ ব্যবহারের সময় কপির উপর একটা সাদা কাগজ ধরা হয় এবং মাঝে-মাঝে সেটা নাড়া হয় যাতে কাগজের কোনো ভাঁজ বা দাগ ইত্যাদির প্রতিবিম্ব নেগেটিভে না আসে। এই স্টপ ব্যবহারের ফলে নেগেটিভের সর্বত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন ডট সৃষ্টি হয় (একেই বলে ফ্ল্যাশিং)। এরপর হিসেব করে প্রয়োজনীয় আকারের একটি চৌকো স্টপ লাগিয়ে এমনভাবে এক্সপোজার দেওয়া হয় যাতে ছবির প্রতিবিম্ব নেগেটিভে গৃহীত হয়। এই এক্সপোজারের মান হিসেব করা হয় এইভাবে—স্ক্রিন ব্যবহার না করে ছবি তুলতে যতক্ষণ এক্সপোজার দিতে হত এখানে তার মোটামুটি ভাবে পাঁচগুণ বেশি সময় লাগবে।
বেশিরভাগ সাধারণ হাফটোন ছবির ক্ষেত্রে দুটি এক্সপোজারই (দু’ধরনের স্টপ ব্যবহার করে) যথেষ্ট (কোনোরকমের দায়সারা কাজ)। কিন্তু জটিল ছবির ক্ষেত্রে যেমন ধরা যাক একটি ‘ফ্ল্যাট’ বা ভোঁতা ছবি—যার মধ্যে বৈষম্য ও উজ্জ্বলতার অভাব, যার হাইলাইট অংশ তুলনামূলকভাবে ঘন (dark) এবং শ্যাডো অংশ হালকা (light)—সেক্ষেত্রে কিন্তু আরেকটি স্টপ ব্যবহার করে আরেকবার এক্সপোজার দেওয়া দরকার। এই তৃতীয় স্টপটিই হল বর্ধিত-কোনা বিশিষ্ট চৌকো স্টপ, যা জয়েনিং আপ ঘটাতে সাহায্য করবে। এইসব বিভিন্ন এক্সপোজারের মধ্যকার অনুপাত নির্দিষ্ট করা অসম্ভব। বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা মারফতই তা জেনে নিতে হয়।
এই ঠেকে শেখার ও হাতড়ে বেড়ানোর ‘এম্পিরিকাল’ প্রণালীর অবসান ঘটাতেই উপেন্দ্রকিশোরের গবেষণা। তিনি চেয়েছিলেন টপ ও এক্সপোজার ব্যবহারের মধ্যে বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা।। এবং সে কাজ শুধু ব্যবহারিক দক্ষতা দিয়ে হয় না, তাঁর জন্যই প্রয়োজন তত্ত্ব-অনুশীলন। উপেন্দ্রকিশোর ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ‘পেনরোজ পত্রিকায় সচিত্র গাণিতিক ও জ্যামিতিক আলোচনা সহকারে মাল্টিপল স্টপ তৈরি করার ও ব্যবহারের প্রণালী ব্যাখ্যা করেন। মালটিপল স্পট ব্যবহার করলে একাধিক সিঙ্গল স্টপ ও একাধিক এক্সপোজারের আর প্রয়োজন পড়ে না।
১৮৯৯-এর ‘দা হাফটোন থিওরি গ্রাফিক্যালি এক্সপ্লেন্ড’ প্রবন্ধে তিনি স্লিট আকৃতির একটি মালটিপল স্টপের কথা বলেছেন। ‘ডিফ্র্যাকশান হাফটোন’ (১৯০২-০৩) প্রবন্ধে উল্লিখিত তাঁর ডিফ্র্যাকশান স্টপের কথা আগেই বলা হয়েছে, এটিও ‘মালটিপল স্টপ’। ‘দা সিক্সটি ডিগ্রি ক্রস-লাইন স্ক্রিন’-এ (১৯০৫-০৬) তিনি এই স্ক্রিনের উপযোগী ‘মালটিপল স্টপ’ এবং এই একটিমাত্র স্ক্রিন নিয়ে ‘থ্রি কালার হাফটোন’ তৈরির উপযোগী স্টপ নির্মাণের পদ্ধতি (ব্যাখ্যা সমেত) বর্ণনা করেছেন। তবে ‘মালটিপল স্টপস’ (১৯১১-১২) নামে ‘পেনরোজে প্রকাশিত তাঁর শেষ রচনাটি এ-বিষয়ে ব্যবহারিক কর্মীদের (গবেষকদেরও) পক্ষে আজও অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। এর মধ্যে নানা ধরনের ‘মালটিপল স্টপ’-এর সচিত্র বর্ণনা আছে। এই ‘মালটিপল স্টপস’ প্রবন্ধটিতে আছে এই স্টপগুলি দিয়ে প্রস্তুত ব্লক থেকে মুদ্রিত চিত্রের নমুনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি আলোকচিত্র থেকে চারভাবে প্রস্তুত (একটি নর্মাল-দূরত্বে গোলাকার স্টপ দিয়ে, ও বাকি তিনটি তিন ধরনের মালটিপল স্টপ দিয়ে তোলা) চারটি হাফটোন ছবি। তাছাড়া হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের একটি আলোকচিত্র থেকেও চারভাবে প্রস্তুত হাফটোন ছবি।
কিন্তু শুধু আবিষ্কারের নেশাতেই আবিষ্কার করে গেছেন মানুষটা। লাভ ক্ষতির কথা না ভেবেই। লীলা মজুমদার লিখেছেন ‘সে লেখার বেলাও যেমন, ছবির বেলাও তেমন। হাফটোন ব্লক তৈরির অমন যুগান্তকারী উন্নতি করে, তার ফল দান করে দিলেন পেনরোজ কোম্পানিকে অকাতরে। কিছু গোপন রাখলেন না। বিলেতে কতজনে লাখপতি হয়ে গেছেন, উপেন্দ্রকিশোরের সেদিকে ভ্রূক্ষেপও ছিল না। জিনিসটা তৈরি করেই খুশি, অন্যদের কাজে লাগছে বলেই কৃতার্থ হয়ে গেলেন। এ-রকম মানুষ ব্যবসার জগতে বড় একটা দেখাই যায় না। শুধু বিলেতে কেন, কলকাতায়ও ইউ রায় অ্যাণ্ড সন্সের কাছে দীর্ঘকাল কাজ শিখে সব জেনে নিয়ে আরেকটা প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসা খুলেছে লোকে এমনও দেখা গিয়েছিল। উপেন্দ্রকিশোর তাতেও কাতর হয়ে পড়েননি। আসলে লোকনাথের নাতির কাছে টাকার কোনো মূল্য ছিল না। জমিদারির উত্তরাধিকারী তবু বিলাস করেননি কখনো, কিন্তু গবেষণার জন্য, সরঞ্জামের জন্য যখনই টাকা দরকার হয়েছে, জমিদারি থেকে টাকা এসে গেছে। সহজে না এলে কিছু জমি বন্ধক রেখেও টাকার জোগাড় হয়েছে, এর কী ফল হতে পারে, উপেন্দ্রকিশোর সে-বিষয়ে একবারও চিন্তা করেন নি।”
উৎস-
১। প্রসঙ্গ উপেন্দ্রকিশোর-লীলা মজুমদার
২। কারিগরি কল্পনা ও বাঙালী উদ্যোগ- সিদ্ধার্থ ঘোষ
৩। ছবি ছাপার কল-কৌশল ও উপেন্দ্রকিশোর- সিদ্ধার্থ ঘোষ
৪। Essays on Half Tone Photography- Upendrakisore Roy Chowdhury (Jadavpur University)