উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম বাংলা মতে ২৭ বৈশাখ, ১২৭০। সে বছর, মানে ১৮৬৩-তে এই দিনটা ছিল ১২ মে। এ বছর সেটাই আজকের দিনে। বিহার থেকে দেও পদবীধারী একটি পরিবার চাকদহে বাসা বাধেন। এই দেও থেকে পরে এঁরা দেব উপাধি পান। দেব পরিবারের রামসুন্দর ষোড়শ শতকের শেষদিকে পূর্ববঙ্গের শেরপুরে চাকরিসূত্রে এসেছিলেন। নবাব ইশা খাঁ-এর জমিদারির সেরেস্তায় চাকরির সুবাদে ক্রমাগত তাঁর পদোন্নতি হতে থাকে। পদবিও বদলায়। দেব থেকে মজুমদার, খাসনবীশ, মুন্সী হয়ে শেষে পাকাপাকি রায় উপাধি পেলেন তাঁরা।
এই পরিবারের একটা অংশ ময়মনসিংহের মসুয়া গ্রামে বাস করতেন। কালীনাথ রায়, (যিনি আবার শ্যামসুন্দর মুন্সী নামেও পরিচিত ছিলেন) পারসি ভাষায় দারুণ পণ্ডিত। তাঁরই ছেলে উপেন্দ্রকিশোর। অনেকেই হয়তো জানেন, উপেন্দ্রকিশোরের জন্মনাম কামদারঞ্জন (যেমন সত্যজিতের প্রসাদ)। জ্ঞাতি ভাই হরিকিশোর রায় চৌধুরী দুই বার বিয়ের পরেও কোনো সন্তান না হওয়ায় তিনি কামদাকে দত্তক নিলেন উপেন্দ্রকিশোর নামে। তবে উপেন্দ্রকিশোর নিজেও এই চৌধুরী নিয়ে খুব একটা স্বস্তি পেতেন বলে মনে হয় না। ১৮৯৭-তে বিদেশি কাগজে প্রবন্ধ লেখার সময় তিনি চৌধুরীকে ছেঁটে ফেলেছেন নাম থেকে। ব্যবসা শুরু করছেন ইউ. রায় নামে। এদিকে আবার টুনটুনির বইতে চৌধুরী ফিরে আসছে। হয়তো একমাত্র সাহিত্যিক সত্তাতেই নিজেকে চৌধুরী আখ্যায় ভূষিত করার একটা চেষ্টা তাঁর মধ্যে ছিল, কে জানে?
কলেজ জীবন থেকেই ফটোগ্রাফি চর্চা আরম্ভ করেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর সামান্য কিছু রক্ষা পেলেও বেশিরভাগ ছাপা হয়েছিল সেকালের বিখ্যাত ম্যাগাজিন পেনরোজ’স অ্যানুয়ালে। ১৮৯৫ সালেই ৩৮/১ শিবনারায়ন দাস লেনে উপেন্দ্রকিশোর ইউ.রায়, আর্টিস্ট নামে ছবি তোলার ব্যবসা শুরু করেন। পুণ্যলতা দেবীর লেখায় বাড়িটির কথা পাই। মাঝারি রকমের বাড়ি, এক ঘরে স্টুডিও, অন্য ঘরে ছোটো ছাপার প্রেস। বড় বারান্দায় নানারকম যন্ত্রপাতি রাখা হল, আর স্নানের ঘরকে করা হল ডার্ক রুম। ১৮৯৬ সালের ২৫ নভেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকার বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে তিনি ফটোগ্রাফির পাশাপাশি হাফটোন ব্লক নিয়েও কাজ করছেন। তখনও অবশ্য তিনি ইউ রায়, বি.এ., এন্ড সন্স যোগ হয়নি।
ফোটোগ্রাফি বা পেইণ্টিংয়ের প্রতিচ্ছবি সুলভে বইয়ের পাতায় ছাপার প্রথম ব্যবস্থা হলো, উনিশ শতকের শেষের দিকে, হাফটোন ব্লকের প্রচলনের পর। হাফটোন ব্লক তৈরি করার জন্য এক বিশেষ ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করতে হয়, যা প্রসেস ক্যামেরা নামে পরিচিত। মুদ্রণ বিশারদ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কারিগরি গবেষণা এই প্রসেস ক্যামেরা সংক্রান্ত। প্রসেস ক্যামেরা ব্যবহারের পদ্ধতির মধ্যে গাণিতিক নির্ভুলতা আনা ও এই ক্যামেরাকে অভিনব ভাবে ব্যবহার করার বহু উপায় তিনি বাতলেছিলেন। সেকালের মুদ্রণজগতের লোকের কাছে ‘পেনরোজ’ পত্রিকাটি ছিল বাইবেলের মতো। এই পত্রিকায় ১৮৯৭ থেকে ১৯১২-র মধ্যে উপেন্দ্রকিশোরের নটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে তার পুত্র সুকুমারের দুটি হাফটোন সংক্রান্ত গবেষণাপত্রও এই ‘পেনরোজ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। পিতা-পুত্রের এই গৌরবে আজ অবধি দ্বিতীয় কোনো বাঙালি ভাগ বসাতে পারেনি। এই হাফটোন নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্র নিয়মিত প্রকাশ পেত ‘পেনরোজ অ্যানুয়াল’-এর মতো খ্যাতনামা জার্নালে। পেনরোজ’ অ্যানুয়্যাল’-এ প্রকাশিত উপেন্দ্রকিশোরের ন’টি রচনার কালানুক্রমিক তালিকা হল :
- Focusing the Screen By U. Ray, 1897, pp.108 to 111.
- The Theory of the Half-tone Dot, Upendrakisor Ray, (Calcutta), 1898, pp. 33 to 40.
- The Half-tone Theory Graphically Explained By U. Ray, 1899, pp. 49 to 53.
- Automatic Adjustment of the Half-tone Screen, By U. Ray, Calcutta, 1901, pp 76 to 80.
- How Many Dots? By U. Ray, Calcutta, 1901, p.81
- Diffraction in Half-tone Theory By U. Ray, Calcutta, 1902-03, pp. 81-91.
- More about the Half-tone Theory By U. Ray, Calcutta, 1903, pp. 17-23.
- The 60° Cross-Line Screen By Upendrakisor Ray, 1905-06, pp. 97 to 102.
- Multiple Stops By Upendrakisor Ray, Calcutta, 1911-12, pp 81-88.
একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন সাক্ষী, উপেন্দ্রকিশোর ব্লক তৈরি করার সঙ্গে-সঙ্গেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বিজ্ঞাপিত হয়েছিল যে, তিনি ৭৫, ৮৫, ১২০, ১৩৩, ১৭০, ২৪০, এমনকি ইঞ্চিপিছু ২৬৬ লাইন বা বিন্দি-বিশিষ্ট হাফটোন ব্লক তৈরি করতে পারেন। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল -
“আজও যদি আমরা ইঞ্চিপিছু ১৩৩ লাইনের চেয়ে সূক্ষ্ম (অর্থাৎ ১৭০ বা তারও বেশি) হাফটোন ব্লক তৈরী করার চেষ্টা করি, কলকাতায় হয়তো গুটিতিনেক প্রতিষ্ঠান সে সুযোগ দিতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুনতে হবে, অত সূক্ষ্ম ব্লক ছাপার উপযোগী কাগজ কোথায়! সেরকম কাগজ পাওয়া গেলেও কিন্তু তাঁরা অক্ষম, কারণ একাজে যে গ্লাস স্ক্রিন দরকার, তা তাঁদের নেই। আমার অনুসন্ধান থেকে যতদূর জানি কলকাতায় ইঞ্চিপিছু ১৭৫ লাইনের বেশি সূক্ষ্ম কোনো গ্লাস স্ক্রিন কারও কাছেই নেই।“
এখানে একটা প্যাঁচ আছে। ১৭০, ২৪০ বা ২৬৬ লাইনের স্ক্রিন হয় এমন কথা কেউ কোনোদিন শোনেনি। তার চেয়েও বড়ো কথা, সত্যিই কিন্তু ১৭০, ২৪০ বা ২৬৬ লাইনের স্ক্রিন কোনোদিনই তৈরি হয়নি এবং যা তৈরি হয়নি তা নিশ্চয় উপেন্দ্রকিশোরের কাছেও ছিল না। তাহলে উপেন্দ্রকিশোরের এই বিজ্ঞাপনের অর্থ কী? একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে ৮৫, ১২০, ও ১৩৩ - এই তিনটি সংখ্যার প্রত্যেকটিকে যদি দুই দিয়ে গুণ করা হয় তাহলে যথাক্রমে গুণফলগুলি দাঁড়ায় – ১৭০, ২৪০ ও ২৬৬। এইখানেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য। উপেন্দ্রকিশোর ৮৫, ১২০ ও ১৩৩ লাইনের গ্লাস স্ক্রিনের সাহায্যেই বিশেষ কৌশলে স্ক্রিন লাইনের দ্বিগুণ সূক্ষ্মতা আনতে পেরেছিলেন হাফটোন ছবিতে। ৮৫ লাইনের স্ক্রিন ব্যবহার করে প্রস্তুত হাফটোন ছবিতে সাধারণত ইঞ্চি পিছু ৮৫ টি ডট(বা বিন্দু) দেখা যায়, কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর এই স্ক্রিনের সাহায্যেই সৃষ্টি করতে পারতেন ইঞ্চি পিছু ১৭০ টি ডট্। এ-বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধ ‘হাউ মেনি ডটস্’ প্রকাশিত হয় ‘পেনরোজ অ্যানুয়াল’-এ (১৯০১)। অর্থাৎ প্রবন্ধ প্রকাশের অন্তত চার-পাঁচ বছর আগেই তিনি হাতে-কলমে এবিষয়ে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। শুধু স্ক্রিন লাইনের দ্বিগুণ নয়, চারগুণ ডট-বিশিষ্ট ছবিও তিনি তৈরি করতে পারতেন। ফলে ছবিতে অদ্ভুত এক কোমলতা আসত, যা আগে কেউ কোনোদিন দেখেনি।
বঙ্গীয় গ্রন্থচিত্রণ’ প্রবন্ধে কমল কুমার মজুমদার লিখেছেন, “বাংলায় আধুনিক গ্রন্থ-চিত্রণে দুইজন আমাদের চৈতন্য দিয়া থাকেন—ধার্মিক গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্যজন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।” ‘ঠাকুমার ঝুলি’র জন্য আঁকা, গ্রন্থকার দক্ষিণারঞ্জনের ছবিগুলিকে কাঠ খোদাই করে ব্লক তৈরি করেছিলেন খ্যাতনামা প্রিয়গোপাল দাশ ও আরও তিনজন। কমলকুমার সম্ভবত জানতেন না, গগনেন্দ্রনাথের ছবিগুলির ব্লক নির্মাণ করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। প্রিয়গোপালের বুলির আঁচড়ে কাঠের ব্লক তৈরি করার উপযোগী করেই ছবিগুলি এঁকেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। উপেন্দ্রকিশোর ফটোগ্রাফির সাহায্যেও এই ব্লক তৈরি করে দিতে পারতেন, কিন্তু কোনো উড-ব্লক নির্মাতার সাধ্য ছিল না গগনেন্দ্রনাথের ছবির তরল রঙের ছড়িয়ে পড়া আর ঘন হওয়াকে মুদ্রণোপযোগী রূপ দেওয়া।
অন্যদিকে, লিথোগ্রাফিতে রবি বর্মা ও অন্নদাপ্রসাদ বাগচী এবং কাঠ-খোদাইয়ে ত্রৈলোক্যনাথ দেব ও প্রিয়গোপাল দাশ প্রমুখের প্রতিভাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েও স্বীকার করতে হবে যে, গ্রন্থ-চিত্রণের জগতে লিথোগ্রাফি, উড ও স্টিল এনগ্রেভিং ও এচিং ইত্যাদিকে যদি এক একটি জানলা রূপে কল্পনা করা যায়, তবে হাফটোন-এর বাতায়নই সেখানে সবচেয়ে বেশি রং আর তার আমেজ ছড়িয়েছে। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রকিশোর কৃত ব্লক থেকে রঙিন প্রতিচ্ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর ‘প্রবাসী’ সম্পাদককে চিঠি দিয়েছিলেন রবি বর্মা। সম্পাদকের ভাষায়, “রবি বর্মা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ইহার প্রশংসা করেন।” উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ রায় এন্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠানেই হাতেখড়ি হয় কলকাতার যাবতীয় হাফটোন ব্লক-কুশলীদের – যাঁদের অনেকেই পরবর্তীকালে স্বাধীনভাবে ব্যবসায় নামেন। কলকাতায় হাফটোন ব্লক নির্মাণ কালক্রমে কুটিরশিল্পের মতো হয়ে দাঁড়ায়। এটা এক ধরনের চেন-রিঅ্যাকশান—এক থেকে দুই, দুই থেকে চার করে যা প্রসারিত হয়।
(ক্রমশ)
উৎস -
১। প্রসঙ্গ উপেন্দ্রকিশোর-লীলা মজুমদার
২। কারিগরি কল্পনা ও বাঙালী উদ্যোগ- সিদ্ধার্থ ঘোষ
৩। ছবি ছাপার কল-কৌশল ও উপেন্দ্রকিশোর- সিদ্ধার্থ ঘোষ
৪। Essays on Half Tone Photography- Upendrakisore Roy Chowdhury (Jadavpur University)