অপরাধীদের পাকড়াও করা বা শাস্তি দেওয়া তো অনেক দূরের কথা, আদৌ সেই সদিচ্ছাটাই পুলিশ বা প্রশাসনের আছে কিনা, সেই নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করছেন খোদ উত্তরপ্রদেশেরই একাধিক মানবতাবাদী কর্মী। কথা হচ্ছিল গত এক বছরে উত্তরপ্রদেশে ঘটে যাওয়া একাধিক ধর্ষণকাণ্ডের প্রসঙ্গে। এমনকি, সম্প্রতি হাথরসের এক নির্যাতিতার বাবাকে হত্যা করেছেন সদ্য জামিনে মুক্তি-পাওয়া অভিযুক্ত। তাতেও হেলদোল নেই সে-রাজ্যের প্রশাসনের। এই নারকীয় পরিস্থিতির শেষ কোথায়?
মানবতাবাদী কর্মীরা এইসব ক্ষেত্রে দায়ী করছেন সরকারকেই। পুলিশ প্রশাসনকে সুতোয় বাঁধা পুতুল করে রেখেছে যোগী সরকার, তেমনই মত তাদের। বস্তুত বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে যে, এই ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যে ধরনের অভিব্যক্তি হওয়া প্রয়োজন ছিল পুলিশের, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। বদলে যেন মনে হচ্ছে পুলিশ সমস্ত ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিতেই উঠে পড়ে লেগেছে। তড়িঘড়ি নির্যাতিতা কিশোরীর লাশ জ্বালিয়ে দেওয়া, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ধর্ষণের উল্লেখও না করা, রাজনীতিবিদ হোক অথবা সাধারণ মানুষ, প্রতিবাদ করতে এলেই তাদের ওপর যথেচ্ছ শক্তি প্রদর্শন করা— এই সবই যেন এখন পুলিশের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং কোথায় সুশাসন, তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
উত্তরপ্রদেশের প্রখ্যাত সমাজকর্মী এবং মানবতাবাদী কর্মী বীণা রানা জানাচ্ছেন, আইনকানুন এবং প্রশাসনকে দিশা দেখাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ যোগী সরকার। তাই নানাভাবে মানুষের নজর ঘুরিয়ে রাখতে চাইছে তারা। তার সঙ্গেই এই ধরনের ঘটনা যখন ঘটছে এবং তা নিয়ে শোরগোল শুরু হচ্ছে, সেগুলো আদতে সুবিধাই করে দিচ্ছে সরকারের। অন্যান্য সমস্যাগুলো থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দিতে নিজেদের কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে না আর তেমন।
বীণার কথায়, উত্তরপ্রদেশের বর্তমান সরকার গণতন্ত্রকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে যেন রোজ। সরকারের বিরুদ্ধে কেউ আওয়াজ তুললেই নানাভাবে অপদস্থ করা হচ্ছে তাকে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মূল সমস্যাটা যেন দাঁড়িয়ে আছে সেই চিরাচরিত পিতৃতন্ত্রের উপরেই। এই রাজ্যের সরকার থেকে শুরু করে ডাক্তার, পুলিশ-প্রশাসন সবাই যেন এই এক অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত। এই রোগের উপসর্গ হিসেবে প্রথমেই কোণঠাসা করে দেওয়া হচ্ছে মহিলাদের। অন্যদিকে ‘নিচু জাত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে যাদের, রীতিমতো পায়ের তলায় পিষে ফেলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তাদেরকেও রোজ। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়িয়েছে যে, যেনতেন প্রকারেই এই নিচু জাতকে আরও পদদলিত করতে শেষমেশ এই একটাই অস্ত্র পড়ে রয়েছে পিতৃতন্ত্রের হাতে; আর সেটা হল— ধর্ষণ।
আরও পড়ুন
ধর্ষণ শুধুই যৌনাঙ্গ-নির্ভর নয়; যৌনতার ভাষা শিখতে হবে প্রথমে : মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
এটা ছাড়াও আরও একটা ভিন্ন পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করছেন বীণা। এই যে বারবার যে-কোনো অপরাধ করার পরেও অপরাধীরা ধরা পড়ছে না, নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না পুলিশ প্রশাসনের, এর ফলে একটা অন্য বার্তা পৌঁছচ্ছে আখেরে সেই অপরাধীদের কাছেই। অপরাধীরা যেন বুঝতে পারছে, দরকার শুধু একটা রাজনৈতিক ছত্রছায়া। তাহলেই যে-কোনো অপরাধই তারা করুক না কেন, আদতে শাস্তি তাদের কিছুই হবে না। এর ফলে একদিকে যেমন পরবর্তী অপরাধের জন্য বিন্দুমাত্র হাত কাঁপছে না তাদের, অন্যদিকে ভবিষ্যতের অপরাধীকেও আস্কারা দেওয়া হচ্ছে এমনভাবে। একপ্রকার যেন, ভবিষ্যতের অপরাধীদের কাছে অভয় বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে অপরাধ করার আগেই।
তাই একদিকে যেমন ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটনকারীদের অবিলম্বে সাজা দেওয়া প্রয়োজন, তেমনই ভুলে গেলে চলবে না ধর্ষিতার কথাও। তাকেও সাহস যোগাতে হবে মনে। মনে করিয়ে দিতে হবে যে, এই লজ্জা তার নয়, এই লজ্জা নিতান্তই ধর্ষণকারীর। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, জীবনটা এখানেই শেষ হয়ে গেল না। বরং আরও অন্যদের পাশে দাঁড়ানোর নতুন লড়াই শুরু হবে এখন থেকেই।
আরও পড়ুন
থানা অব্দি পৌঁছয় না অনেক ধর্ষণের ঘটনাই, ক্ষোভে ফুঁসছেন উত্তরপ্রদেশের সমাজকর্মী রূপরেখা ভার্মা
দেশের ধর্ষণের মানচিত্রটা তাই বদলে ফেলার প্রয়োজন। তার জন্য যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেটাই নেওয়া হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মূল দাবি এখন এটাই। তার সঙ্গেও বদলে ফেলতে হবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাও। ভবিষ্যতের ‘রেপিস্ট’ তৈরি হওয়াকেও রোধ করতে হবে যে কোনও ভাবেই। কী ভাবে তা করা যায়, সেটা ভাবতে হবে প্রকল্প প্রণয়নকারীদের। ভাবতে হবে সরকারকে, পুলিশ-প্রশাসনকে। কিন্তু চাওয়া এটুকুই যে, খোলা হাওয়ায় যাতে শ্বাস নিতে পারে সমস্ত ধর্ম বা জাতের মেয়েরা।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুন
২ সপ্তাহ লড়াইয়ের শেষে মৃত্যু দলিত যুবতীর; কেন ধর্ষণ রুখতে বারবার ব্যর্থ উত্তরপ্রদেশ?
Powered by Froala Editor