উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম লোথরুতে বেড়ে ওঠা তাঁর। বাবা সামান্য কৃষক। ফলে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই দেখে আসছেন তিনি। সেইসঙ্গে আঠারোর গণ্ডি পেরতেই, পাড়া প্রতিবেশীদের থেকে উঠতে-বসতে শুনতে হত বিয়ের কথা। তবে সমস্ত তীর্যক উক্তি, প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়েই তৈরি করেছিলেন এক নতুন নজির। গড়েছিলেন দু-দুটি জাতীয় রেকর্ড। তবে দীর্ঘস্থায়ী হল না সাফল্যের স্বাদ। গত ৪ অক্টোবর উত্তরাখণ্ডের তুষারধ্বসে (Avalanche) প্রাণ হারালেন ২৬ বছর বয়সি তরুণ পর্বতারোহী।
সবিতা কনসওয়াল (Savita Kanswal)। হ্যাঁ, প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে মাত্র ১৬ দিনের মধ্যেই মাউন্ট এভারেস্ট ও মাকালু জয় করেছিলেন তিনিই। তাছাড়াও এই বছরে ১০টি ছ-হাজারি শৃঙ্গ অভিযান করেও তৈরি করেছিলেন জাতীয় রেকর্ড। তবে দ্রৌপদী কা দণ্ডে পর্বত থেকে ফেরার পথেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা। উত্তরাখণ্ডে ভয়াবহ তুষারধ্বসে চিরকালের মতোই থেমে যেতে হত তাঁকে। সবিতা ছাড়াও, ৪১ জন পর্বতারোহীর এই দলের মধ্যে নিখোঁজ আরও ২২ জন। তাছাড়াও স্থানীয় ও পর্যটক মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২০ জন।
তখন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রী সবিতা। স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দৌলতে স্কুলে আয়োজিত হয়েছিল ‘অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস’-এর অনুষ্ঠান। সেখানেই প্রথম পর্বতারোহণের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। তবে সবিতার নজর কাড়ে ভিন্ন একটি বিষয়। পুরুষদের সাদর আমন্ত্রণ জানানো হলেও, পর্বতারোহণে মহিলাদের অংশগ্রহণ তীর্যকভাবে দেখে সমাজ। এই পুরুষতান্ত্রিকতাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জুগিয়েছিল তাঁকে।
তবে চাইলেই তো আর পর্বতারোহী হওয়া যায় না? তার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। প্রয়োজন অর্থেরও। মেয়ের স্বপ্নপূরণ করতে সঞ্চয় ভেঙেই, তাঁকে উত্তরাখণ্ডে পাঠিয়েছিলেন সবিতার বাবা-মা। অবশ্য তাতেও শব্দবাণ ধেয়ে এসেছিল গ্রামের মানুষদের থেকে। অবিবাহিত মেয়েকে ভিনরাজ্যে পাঠানো কি আদৌ শোভন? প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকেই। তবে হার মানেননি সবিতা। পিছিয়ে আসেননি তাঁর বাবা-মাও।
নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর পর্বতারোহণকেই পেশা হিসাবে বেছে নেন তিনি। দেরাদুনের মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে যোগ দান করেন অতিথি প্রশিক্ষণ হিসাবে। সেইসঙ্গেই শুরু হয় পর্বতাভিযান। ২০১৮ সালে দ্রৌপদী কা দণ্ড-জয়ের মধ্যে দিয়েই সংবাদপত্রের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। ২০২১ সালে জয় করেছিলেন বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট লোৎসে। তাছাড়া চলতি বছরে এভারেস্ট-সহ ১০টি শৃঙ্গজয় করে এক নতুন নজির গড়েছিলেন তিনি। আশ্চর্যের বিষয় হল, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর পর্বতারোহণের কেরিয়ার সেই দ্রৌপদী কা-দণ্ডই সাক্ষী থাকল তাঁর শেষ অভিযানের। এও যেন এক অদ্ভুত সমাপতন। তবে শুধু জাতীয় রেকর্ড তৈরির মধ্যেই কৃতিত্ব লুকিয়ে নেই সবিতার, পুরুষতান্ত্রিকতা ও বৈষম্যের বেড়াজাল ভেঙে পর্বতারোহণকে প্রান্তিক অঞ্চলেও সার্বজনীন করে তুলেছিলেন সবিতা। সেখানেই অনন্য তিনি। সবিতার এই কৃতিত্ব পরবর্তী প্রজন্মের তরুণীদের অনুপ্রেরণা জোগাবে, তাতে আর সন্দেহ কীসের?
Powered by Froala Editor