উৎসবের মরসুম যতই এগিয়ে আসছে, ততই তার সঙ্গে আরও বেশি করে মিশে যাচ্ছে রাজনীতি। তার থেকেও বড়ো কথা, যেভাবে ধর্মীয় সমীকরণকে ওলট-পালট করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবার আঞ্চলিকতার প্রয়োগ করা হচ্ছে সেখানে, তা আরও বেশি নিন্দনীয়। এবার দুর্গাপুজো নিয়ে অভূতপূর্ব নিদান জারি করল উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার। জানানো হল, এবার যোগী-রাজ্যে কোথাও প্যান্ডেল করে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা যাবে না। অজুহাত, করোনার সংক্রমণ আটকানো। যদিও রামলীলা পালনের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ কিন্তু আরোপ করা হয়নি।
করোনা পরিস্থিতি যথেষ্ট ধাক্কা দিয়েছে এবার প্রাক উৎসবের মরসুমেও। উদযাপন মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর জন্যেও। নানা রকম বিধি-নিষেধও আরোপ করা হচ্ছে। একদিকে যেমন পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও কাটছাঁট করা হচ্ছে ব্যয়বাহুল্য, তেমনই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একাধিক বিধি কঠোর ভাবে মেনে চলার পরামরশ দেওয়া হয়েছে রাজ্যগুলির তরফে। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি আরও যে সমস্ত রাজ্যে দুর্গাপুজো পালন করা হয়, প্রস্তুতি নিয়ে আলাদা আলাদা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেখানকার সরকার।
করোনা আবহের মধ্যে আসামে এবার পালন করা হয়নি সেখানকার সবথেকে ঐতিহ্যপূর্ণ বিহু উৎসবও। সুরক্ষা বিধি মানতে সেখানকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা অনুরোধ জানিয়েছেন, প্রতিমা পূজা না করে এই বছরের মতো পুজো কমিটিগুলি যেন ঘট পুজোর মাধ্যমেই উদযাপন সারেন। একাধিক বিধিনিষেধ মেনে দুর্গাপুজোর কথা ঘোষণা করেছে উড়িষ্যা বা ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যও। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য উৎসবের জন্য যে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেটাই লাগু হয়েছে দুর্গাপুজোর ক্ষেত্রেও। উড়িষ্যাতে তো ঐতিহ্যপূর্ণ পুরীর রথযাত্রাতেও কাটছাঁট করা হয়েছিল ব্যাপকভাবে। কিন্তু যোগী আদিত্যনাথ সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করল, তা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। স্বভাবতই যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছে এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজ্যের কোথাও জমায়েত করা যাবে না দুর্গাপুজো উপলক্ষে। যদি একান্তভাবেই কেউ পুজো করতে চান, তবে তাদেরকে নিজের বাড়ির মধ্যেই আয়োজন করতে হবে পুজোর। যদিও বিতর্ক শুরু হয় তার পরবর্তী সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা হতেই। জানানো হয় রাজ্যের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখেই যথারীতি আয়োজন করা হবে রামলীলা উৎসবের। নেওয়া হবে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। কোভিড বিধি মেনে চলা হবে যথাযথ ভাবে। এখানেই প্রশ্ন উঠছে যে, যদি ঘটা করে রামলীলা আয়োজন সম্ভব হয় তাহলে সেই একই কোভিড বিধি মেনেই দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল তৈরি করতে দিতে আপত্তি উঠছে কেন?
এছাড়াও আদিত্যনাথ সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, দুর্গাপুজো উপলক্ষে কোনোরকম শোভাযাত্রা কিংবা পদযাত্রা বের করা যাবে না। আয়োজন করা যাবে না কোনো রকম মেলাও। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনে হাত স্যানিটাইজ করে, মাস্ক পরে অথবা পরিছন্নতা বিধি পালন করে যদি রামলীলা উৎসব অনুষ্ঠিত করা যায়, তবে দুর্গাপুজোও তো একইভাবে আয়োজন করা যেত? প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি উৎসবের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক ভাগ-বাটোয়ারা শুরু হয়ে গেল? দুর্গোৎসবকে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষদের উৎসব বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা কি তাহলে এটাই? অথচ দুর্গাপুজোর পৌরাণিক ব্যাখ্যার দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, স্বয়ং রামচন্দ্রই কিন্তু দেবী দুর্গার আরাধনা করে ডেকে এনেছিলেন তাকে মর্ত্যভূমিতে। শুরু হয়েছিল দেবীর অকালবোধন উৎসব। সেই রাম ভগবানের উৎসবে ছাড়পত্র দিলেও, সরকারি গেরোয় আটকে যাচ্ছে স্বয়ং তাঁর আরাধ্যেরই পুজো!
সাম্প্রতিককালে বারবারই কেন্দ্রের শাসক দলের প্রতি অভিযোগ এসেছে বাঙালি বিদ্বেষের। তবে এটাকে ‘বিদ্বেষ’ না বলে একটি সূক্ষ্ম ভেদাভেদের রাজনীতি বলাই যুক্তিযুক্ত। প্রাথমিকভাবে ব্যাপারটি ছিল এক ধর্মের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মকে লড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু বর্তমানে এই ধর্মীয় ভেদাভেদের অন্য একটা চেহারা দেখা যাচ্ছে। একই ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে একটি বিভাজন রেখা। এবং উদ্দেশ্যটাও এক্ষেত্রে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাব আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রকট প্রচেষ্টা চলছে দেশের সমস্ত কোণে। সেটার জন্য সবার আগে দরকার আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে কোণঠাসা করে ফেলা। আর সেই কাজটাই অত্যন্ত সুচতুরভাবে করে চলেছে এই সরকার।
আরও পড়ুন
সনাতনী বাংলা থেকে আলাদা করতে হবে 'বাংলাদেশি' ভাষা! চর্চা চলল বর্ণপরিচয়-স্রষ্টার জন্মদিনেই
তাই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের এই পদক্ষেপ যতই বাঙালিদের হতাশ করুক না কেন, তাতে সরকারের কিছুই হেলদোল নেই। ঐতিহাসিকভাবেই উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালি সম্প্রদায়ের বসবাস। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীকে অপর একটি ভৌগোলিক পরিসীমার মধ্যে ‘সংখ্যালঘু’ করে ফেলার প্রাথমিক পদক্ষেপ সম্ভবত এটাই। এবং এই কাজে তারা যে মোটামুটি ভাবে সফল, সেটাও বলতেই হয়। নইলে বাংলা থেকেই এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের থেকেও শোনা যাচ্ছে যে, দুর্গাপুজোর বিধিনিষেধ এলে বাংলায় ছটপুজোর অনুমতি দেওয়া হবে কেন!
সুতরাং এই বিভাজনের রাজনীতির ফাঁদে না বুঝে পা ফেলে দিলে অত্যন্ত ক্ষতিকর একটা ভবিষ্যৎ যে অপেক্ষা করে আছে, তা বলাই বাহুল্য। দরকার দেশের মানুষের বিবেচনাবোধের। ভরসা সেই মানুষই। রবি ঠাকুর যেমন বলেছিলেন: মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুন
দেশজুড়ে পথে নামছেন কৃষকেরা, কৃষি বিল কি পালে হাওয়া তুলে দিল বিরোধীদের?
Powered by Froala Editor