শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। তবে বাংলাদেশের সিনেমাপাগল দর্শকদের কাছে তিনি পরিচিত সালমান শাহ নামেই। অনেকের কাছে তাঁর পরিচয় ‘মহানায়ক’ কিংবা ‘চলচ্চিত্রের যুবরাজ’ হিসাবেও। ১৯৯৩ সালে রূপোলী পর্দায় প্রথম আত্মপ্রকাশ সালমান শাহের। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে। এর পরে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই করেছেন ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয়। যার প্রত্যেকটিই বাণিজ্যিকভাবে সফল বাংলাদেশের সিনেমা জগতে। কিন্তু জনপ্রিয় এই চলচ্চিত্র তারকার অভিনয় জীবন বাঁধা পড়ে গিয়েছিল মাত্র তিন বছরের গণ্ডিতেই।
১৯৯৬ সাল। কেরিয়ারের মধ্য গগনে তখন সালমান শাহ। দিনটা ছিল ৬ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকারের সঙ্গে ছিল তাঁর দেখা করার দিন। নতুন কাজ নিয়েই বেশ কিছু কথাবার্তার পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু বেলা গড়িয়ে যেতেও দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন না সালমান শাহ। অনেক ডাকাডাকির পর শেষ অবধি চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই তাঁর স্ত্রীর চোখে পড়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত দেহ। আত্মহত্যা, নাকি খুন হয়েছিলেন সালমান শাহ?
এই প্রশ্ন ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে রহস্য। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে। পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন পুলিশি সংস্থা তদন্ত করলেও স্পষ্ট রিপোর্ট উঠে আসেনি কখনোই। শেষ অবধি ২০২০ সালে পিবিআই এই তদন্তের রায় দেয়। তাঁদের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় আত্মহত্যাই করেছিলেন সালমান শাহ। কিন্তু বিখ্যাত এই চলচ্চিত্র তারকার মৃত্যু ঘিরে এই বিতর্কের কারণ কী?
বাংলাদেরশে একটি মাফিয়া চক্রের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিল সালমান শাহের নাম। এমনকি এই বিবাদের রেশ পৌঁছেছিল অভিনেতা সমিতিতেও। কয়েক সপ্তাহের জন্য তাঁর অভিনয়কে নিষিদ্ধ করেছিল শিল্পী সমিতি। অন্যদিকে মৃত্যুর বছর খানেক আগেই যেন অঘোষিত ভবিষ্যদ্বাণী করে দিয়েছিল বাংলাদেশের এক দৈনিক ‘ইনকিলাব পত্রিকা’। লেখা হয়েছিল রয়েছে তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা। এর পরে দু’বার আক্রান্তও হন সালমান শাহ।
পিবিআইয়ের আগে ডিবি, সিআইডি এবং র্যা ব পৃথকভাবে তদন্ত করেছিল এই মৃত্যুরহস্যের। তবে প্রত্যেকক্ষেত্রেই তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ তুলেছিলেন সালমান শাহের পরিবার। রিপোর্টে ‘আত্মহত্যা’-র কথা উল্লেখ থাকলেও তার কারণ হিসাবে কিছুই বর্ণিত ছিল না সেই তদন্তে। এমনকি বয়ান নেওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র ৪ জন পারিবারিক আত্মীয়ের। তাছাড়া পরিচারিকা, সহ-অভিনেতা এবং ফ্ল্যাটের অন্যান্য কর্মীদেরও জেরা করা হয়নি কোনো।
রহস্য নতুন মোড় নিয়েছিল ১৯৯৭ সালে। মৃত্যুর প্রায় মাস কয়েক পেরিয়ে যাওয়ার পর ‘হত্যার’ মামলা করেছিলেন অভিনেতার বাবা। সেই সময় আদালতে এই রহস্যের মেঘকে ঘনীভূত করে তুলেছিলেন অন্য এক মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া এক বন্দি। রিজভি আহমেদ নামের ওই ব্যক্তি আদালতে দাবি করেছিলেন সালমান শাহকে খুন করা হয়েছিল। সাজানো হয়েছিল আত্মহত্যার প্রেক্ষাপট। তাঁর সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন মোট এগারো জন। সেই বয়ানের ওপরে নির্ভর করেই মামলা করেছিলেন সালমান শাহের বাবা।
আরও পড়ুন
মহিলাদের থেকে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ পুরুষেরা; মানসিক দুর্বলতা নাকি অন্য সংকট?
সন্দেহ থেকে এড়ায়নি তাঁর সুইসাইড নোটও। পারিবারিক ডাকনাম ‘ইমন’-এর পরিবর্তে কেন ভালনাম ব্যবহার করলেন তিনি, নিজের ঠিকানার বদলে লিখলেন পৈতৃক বাড়ির ঠিকানা, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁর মা। এই চিঠিও যেন অতিনাটকীয় করে তুলেছিল প্রেক্ষাপটকে। দ্বিতীয় পর্যায়ের তদন্তে তাঁর ঘর থেকে মিলেছিল চেতনানাশকের ওষুধও। ফলে তাঁকে অচেতন করে হত্যা করার পর ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সিলিং থেকে, উঠে এসেছিল সেই সম্ভাবনাও।
২০১৭ সালে এই তদন্তের দায়ভার গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টগেশন (পিবিআই)। প্রত্যক্ষদর্শী থেকে শুরু করে পরিচিতদেরও বিভিন্ন বয়ান এবং নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করেই এই সংস্থা সাজিয়ে তোলের রহস্যের প্রেক্ষাপটকে। অবশেষে, ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত রায়ে জানানো হয় আত্মহত্যাই করেছিলেন সালমান শাহ। মিডিয়ায় তাঁর সঙ্গে অভিনেত্রী শাবনূরের ঘনিষ্ঠতার চর্চাই জটিল করে তুলেছিল সালমান শাহের দাম্পত্যজীবনকে। মৃত্যুর আগেরদিনও স্ত্রীয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে বিবাদে জড়িয়েছিলেন শাহ, এমনটাই বলা হয় রিপোর্টে। পাশাপাশি তাঁর মায়ের সঙ্গে স্ত্রীয়ের সম্পর্কও খুব এক ভাল ছিল না, তা উঠে আসে তদন্তে। সম্পর্কের এই জটিল বেড়াজালই আবেগপ্রবণ সালমান শাহকে ঠেলে দিয়েছিল মৃত্যুর দিকে। এর আগেও ১৯৯০ সাল নাগাদ দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। সেই তথ্যও প্রকাশ্যে আনে পিবিআই।
যদিও এই রায়কেও অস্বীকার করেছেন সালমান শাহের পরিবার। কেটে গেছে ২৪ বছর। তাও আজও দোলাচলে তারকার মৃত্যু। সম্প্রতি ১৯ সেপ্টেম্বর পেরিয়ে গেল বিখ্যাত এই তারকার আরও একটি জন্মদিন। জীবিত থাকলে পঞ্চাশে পা দিতেন তিনি। হয়তো আরও অনেক ফুল ফুটিয়ে যেতেন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে...
আরও পড়ুন
লঞ্চ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহনন; কোন অবসাদ গ্রাস করেছিল পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে?
তথ্যসূত্রঃ
১. সালমান শাহের মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা?, গোলাম মর্তুজা ও আসাদুজ্জামান, প্রথম আলো
২. যে পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করেছিলেন সালমান শাহ, আমানুর রহমান রনি, বাংলা ট্রিবিউন
আরও পড়ুন
সুপ্রিয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে; ঋত্বিক ঘটককে শর্ত দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
Powered by Froala Editor