একুশ শতকে দাঁড়িয়ে দ্রুত পদক্ষেপেই এগিয়ে চলেছে সভ্যতা। আর মাইলের পর মাইল জুড়ে নির্বিচারে অরণ্যনিধন চলছে নগরায়নের জন্য। ক্রমেই মুছে যাচ্ছে সবুজের আধিক্য। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রকৃতিঘাতকও নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের ওপর। আর এই সমস্যা সমাধেই বারবার উঠে আসছে বৃক্ষরোপণের প্রসঙ্গ। গোটা বিশ্বজুড়ে নেওয়া হচ্ছে গাছ লাগানোর হাজার হাজার উদ্যোগ। তবে আখেরে সত্যিই কি লাভ হচ্ছে তাতে? না, বরং উল্টে ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃতির। সাম্প্রতিক গবেষণা এবার জানল তেমনটাই।
বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নতুন কিছু নয়। ষোলো শতকে ব্রিটেন-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই বৃক্ষরোপণ করা হত জাহাজ নির্মাণের কাঠের সরবরাহ করতে। তারও বহু বহু শতাব্দী আগে রাস্তার দু’ধারে সার দিয়ে বৃক্ষরোপণ হয়েছিল ভারতেই। তাপদাহ থেকে পথযাত্রীদের রক্ষা করতে এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন সম্রাট অশোক। এমন বহু ঘটনা উল্লেখ করেই অস্ট্রেলিয়ার সানসাইন কোস্ট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানাচ্ছেন, বৃক্ষরোপণের জন্য প্রগোটা বিশ্বজুড়ে নেওয়া হচ্ছে গাছ লাগানোর হাজার হাজার উদ্যোগ। তবে আখেরে সত্যিই কি লাভ হচ্ছে তাতে? না, বরং উল্টে ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃতির। সাম্প্রতিক গবেষণা এবার জানল তেমনটাই। থম শর্তই হচ্ছে তার উদ্দেশ্য ঠিক করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে যে বৃক্ষরোপণ হচ্ছে তা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীনভাবে। আর সেই কারণেই বিপদ কমছে বইকি বাড়ছে। ঠিক কেমন?
অধ্যাপক রবিন চ্যাডন জানাচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির জন্য বেছে নেওয়া হয় নির্দিষ্ট কোনো প্রজাতির গাছের চারা। সমগ্র অঞ্চল জুড়েই সেই বিশেষ প্রজাতিটিই রোপণ করা হয়। তাতে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ঠিকই কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রাকৃতিক ভারসাম্যই ও জীববৈচিত্র। অস্ট্রেলিয়া-সহ বেশ কিছু দেশেই এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম বনভূমি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে সুফল মেলেনি খুব একটা। হারিয়ে যাওয়া জঙ্গলের পরিধি বাড়লেও তা সম্পূর্ণ বসবাসযোগ্য করা যায়নি বন্যপ্রাণীদের কাছে। এর কারণ হিসাবে চ্যাডন জানাচ্ছেন, পৃথক পৃথক প্রজাতির পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ বসবাসের জন্য বেছে নেয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। সেইভাবেই গড়ে উঠেছে আমাদের বাস্তুতন্ত্র। কিন্তু মোনোকালচার বন্ধ করে দিচ্ছে সেই সুযোগটাই। সেইসঙ্গে কোনো একটি পরিবেশ বিশেষ কোনো প্রজাতির গাছের উপস্থিতি কমিয়ে দিতে পারে মাটির গুণগত মান, বায়ুতে জলীয় বাষ্পের মাত্রাও।
এখানেই শেষ নয়। অতিরিক্ত বৃক্ষরোপণ কার্বন শোষণের বদলে বাড়িয়ে দিতে পারে কার্বনের মাত্রাও। এমন ঘটনাও দেখা গেছে মেক্সিকো এবং চিলিতে।
আরও পড়ুন
নিধন রুখতে বৃক্ষ-আলিঙ্গন মহিলাদের, উত্তরাখণ্ডে ‘চিপকো আন্দোলনে’র ছায়া
তবে আরও বড়ো প্রশ্ন তুলছেন রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের গবেষক কেট হার্ডউইক। প্রতি বছর গোটা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আদৌ কি হিসাবে রাখা হয় শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকছে কটা গাছ? না, সেই খবর নেওয়া হয় না আর। ফলে অধিকাংশ চারাই মারা যায় অপরিণত অবস্থাতেই। আখেরে তাতে লাভ হয় না কিছুই। শ্রীলঙ্কাতেই গত বছরই এক হাজার হেক্টর অঞ্চলজুড়ে বনভূমি সংরক্ষণে ব্রতী হয়েছিল সেখানকার সরকার। লাগানো হয়েছে প্রায় দেড় কোটি ম্যানগ্রোভ চারা। তবে পরিচর্যা এবং পরিকল্পনার অভাবে মৃত্যু হয় ৮০ শতাংশেরই।
আরও পড়ুন
২৪ বছরে ১১ হাজার বৃক্ষরোপণ, রুক্ষ উপত্যকায় সবুজ বিপ্লব ‘ঠাকুরদা’র
তবে কি বন্ধ করে দেওয়া উচিত বৃক্ষরোপণ? উত্তর, না। এখনও কার্বনের মাত্র, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি পরিবেশজনিত সমস্যার একমাত্র সমাধান বৃক্ষরোপণই। তবে তা করতে হবে সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলি মেনেই। যথাযথ পরিকল্পনা করে। আর সেই কারণেই বৃক্ষরোপণের থেকেও বনভূমি সংরক্ষণে বেশি করে জোর দিচ্ছেন গবেষকরা। শুনতে অনেকটা এক রকম লাগলেও, এই দুইয়ের মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম ফারাক। বনভূমি সংরক্ষণের অর্থ কোনো অঞ্চলের স্বাভাবিকভাবে যে প্রজাতির গাছের অস্তিত্ব রয়েছে, সেই ধরনের গাছেরই রোপণ। তাতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে না। সমস্যার সম্মুখীন হবে না সেখানকার জীববৈচিত্র। এবং অতি অবশ্যই প্রকৃতি বাঁচাতে বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ করার এখনও বিকল্প নেই কোনো, এমনটাই অভিমত গবেষকদের…
আরও পড়ুন
কন্যাজন্মের আনন্দে ১১১টি বৃক্ষ রোপণ, এমনই রীতি রাজস্থানের গ্রামে
Powered by Froala Editor