‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করিবেন না’— এমন বিজ্ঞাপন নানা জায়গায় দেখেছি আমরা। কলকাতা তো বটেই, শহরতলির অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে এমন নিদর্শন। অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়াতেও এমন প্রচার দেখি। এটা তো সত্যি সত্যি করা উচিত নয়। কিন্তু পুরনো কলকাতা কী ভাবছে এই ব্যাপারে? ওখানে ঠিক কেমন হত?
একটা প্রচলিত প্রবাদই আছে, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে।’ আমরাও তো সেই বাঙালিদেরই উত্তরপুরুষ। তখনও মাঝে মধ্যে রাস্তায়ও প্রস্রাব করত কেউ কেউ। এখনকার মতো সুলভ শৌচালয় তো রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছিল না তখন। তাই রাস্তাতেও অনেকে ‘কাজ’ সেরে নিতে বাধ্য হতেন। কিন্তু ব্রিটিশদের আমল, পুলিশ দেখে নিলেই মুশকিল। আর এই নিয়েই একবার উত্তাল হয়েছিল তখনকার সংবাদপত্র। হ্যাঁ, এমন অদ্ভুত খবরও তখন জায়গা পেত কাগজে।
কিন্তু ঘটনাটি ঠিক কী? সালটা ১৮৫৮, অর্থাৎ আজ থেকে ১৬২ বছর আগেকার কথা। কোনো জরুরি কাজে একজন ব্যক্তি বাইরে বেরিয়েছেন। যাওয়ার সময় হঠাৎই তাঁর প্রস্রাবের প্রচণ্ড বেগ পায়। কী করবেন এবার? তার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন রাজপথের ওপর। ব্রিটিশ পুলিশ দেখে নিলেই তো সমস্যা! কিন্তু বেগ যে রোখা যায় না! এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে পড়লেন রাস্তার কোণে। তাড়াতাড়ি ‘কাজ’ শেষ করে যখন চলে আসবেন, তখনই দেখেন বিপদ একেবারে ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ! সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হল নিকটবর্তী থানায়। সেখান থেকে কালীঘাট থানা। এভাবেই ঘুরে ঘুরে শেষে হাজির হলেন মৌলবি সাহেবের (বিচারক) সামনে। সব দেখে শুনে, শাস্তির ‘গুরুত্ব’ বিবেচনা করে চার আনা জরিমানা করলেন তিনি।
এটাই ছিল মূল ঘটনা। আর এতেই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সংবাদ প্রভাকরের একটি প্রতিবেদনে। ১৮৫৮ সালের ২ আগস্টে প্রকাশিত ওই লেখায় ব্রিটিশ পুলিশকে তুলোধোনা করা হয় রীতিমতো। “রাজপুরুষেরা আমারদিগের প্রতি যত পারেন ততই ধুমধামের হুকুম জারি করে থাকেন।” তাঁদের অভিযোগ, ব্রিটিশ সাহেবরা নিজেরা রাস্তাঘাটে যখন তখন প্রস্রাব করছেন, তখন কিছু হচ্ছে না। বাকি শহরবাসীরা করলেই তাঁদের থানা পুলিশ করতে হচ্ছে! এ কেমন দ্বিচারিতা! এটাই কি ‘রাজধর্ম’? এমনই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ সরকারের দিকে।
সংবাদ প্রভাকরের এই দাবি কতটা সত্যি, জানা যায় না। খবর প্রকাশের পর কী হয়েছিল, তাও জানা যায় না। কিন্তু প্রস্রাব করাকে কেন্দ্র করে এমন প্রতিবেদনের নজির কি খুব একটা দেখা গেছে? অবশ্য খেয়াল রাখতে হবে, সময়টা সিপাহি বিদ্রোহের। স্বাধীনতা আন্দোলন জন্ম নিচ্ছে দিকে দিকে। ব্রিটিশ বিরোধিতার সবরকম রাস্তাকেই কাজে লাগানো হচ্ছে। এখানেও হয়তো তা-ই হয়েছে। তবে তখনই হোক বা এখন, শৌচালয় ছাড়া প্রস্রাব করা কখনই উচিত নয়। হলে, পরিণতি তো ইতিহাসেই লেখা…
Powered by Froala Editor