১৯৭৮ সাল। ‘দূরত্ব’ ছবির নির্মাণের মধ্যে দিয়েই বাংলা চলচ্চিত্র জগতে পা রাখা তাঁর। ততদিনে বাংলা সিনেমা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক কিংবা মৃণাল সেনের সৌজন্যে। সেই কিংবদন্তিদের যুগে দাঁড়িয়েও বাংলার সিনেমার এক স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করেছিলেন তিনি। অগ্রজদের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেই নির্মাণ করেছিলেন ভিন্নধারার প্রকাশশৈলী, কাহিনি। চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটকে করে তুলেছিলেন কাব্যময়।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (Buddhadeb Dasgupta)। ২০২১ সালের ১০ জুন চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। এ-বছর, দ্বিতীয় প্রয়াণবার্ষিকীতে, তাঁকে অভিনব সম্মাননা জানাতে চলেছে তিলোত্তমা। আগামী ৯ ও ১০ জুন, কলকাতার বুকে আয়োজিত হতে চলেছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের স্মরণে প্রথম চলচ্চিত্র ও কবিতা উৎসব (Film And Poetry Festival)। নেপথ্যে ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ (Buddhadeb Dasgupta Memorial Trust)। তাছাড়াও এই আয়োজনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট এবং ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যালাইড আর্টস।
বছর দেড়েক আগে, কিংবদন্তি পরিচালকের প্রয়াণের পর পথচলা শুরু হয় ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর। সৌজন্যে, তাঁর স্ত্রী সোহিনী দাশগুপ্ত। গতবছর বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের জন্মদিনে বিশেষ কবিতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল এই স্মারক সংস্থা। প্রদর্শিত হয়েছিল তাঁর নির্মিত ‘উত্তরা’ ছবিটি। এবার সেই ধারা মেনেই, বড়ো মাত্রায় পূর্ণাঙ্গ কবিতা ও চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের মূল প্রেক্ষাগৃহে। উৎসবের পরিচালক এবং মেমোরিয়াল ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সোহিনী দাশগুপ্তের কথায়, “চলচ্চিত্র এবং কবিতার মধ্যে এক আশ্চর্য সেতু নির্মাণ করেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। এই দুই ভিন্নধারার শিল্পমাধ্যমের সংশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই উদযাপিত হবে তাঁর স্মারক উৎসব।”
জানা গেল, বাংলার বৃহত্তর দর্শকমহল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের যে-সকল ছবির সঙ্গে ততটাও পরিচিত নয়, সেগুলির স্ক্রিনিং হবে এই চলচ্চিত্র উৎসবে। উৎসব শুরু হবে ‘কৃষ্ণকলি ও বাঁশি’ দিয়ে। এই চলচ্চিত্রটি ছাড়াও, রবীন্দ্রনাথের কবিতা অবলম্বনে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নির্মিত ১৩টি সংক্ষিপ্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে এই চলচ্চিত্র উৎসবে। দেখানো হবে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘দ্য মেলোডি কন্টিনিউস’। তাছাড়াও তালিকায় রয়েছে গৌতম ঘোষের ছবি ‘মিটিং এ মাইলস্টোন’, অনামিকা হাকসারের ‘ঘোড়ে কো জালেবি খিলানে লে জা রাহা হু’, জি অরবিন্দনের মালায়লম ছবি ‘কুমাট্টি’-ও। উল্লেখ্য, এই চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হতে চলা প্রতিটি সিনেমাতেই প্রধান্য পেয়েছে ভাষার প্রয়োগ, শব্দ ব্যবহার এবং কাব্যময়তা।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি উৎসবের অন্যতম অঙ্গ হিসাবে আয়োজিত হবে ‘পারফর্মেন্স পোয়েট্রি’-র অনুষ্ঠান। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতাপাঠ করবেন শ্রীকান্ত আচার্য। ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা যাবে দেবারতি মিত্রের কবিতা। তাছাড়াও স্বরচিত কবিতাপাঠের আসরে থাকবেন বাঙালি কবি সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইংরাজি ভাষার কবি শর্মিলা রায় এবং ইউক্রেনের কবি ইরিনা ভিকিরচাক।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতায় যেমন জায়গা করে নিত চিত্রময়তা, চলচ্চিত্রে আশ্রয় পেত কাব্য— সবমিলিয়ে ঠিক সেভাবেই যেন কবিতা ও চলচ্চিত্র কাঁধে কাঁধ রেখেই হাঁটবে দু’দিনের এই উৎসবে। কলকাতার বুকে জন্ম নেবে এক আশ্চর্য শিল্পসন্ধ্যা। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য সুমন সাধুর কথায়, “আন্তর্জাতিক স্তরে সমাদৃত হলেও, বাঙালি তথা সর্বভারতীয় পাঠক ও দর্শকমহলের চোখে সেভাবে ধরা পড়েনি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতা ও চলচ্চিত্র। তাঁর সৃষ্টি ও কাল্টকে প্রসারিত করতেই এই আয়োজন। বিশেষত আগামী প্রজন্মের চলচ্চিত্রের ছাত্রছাত্রীদের তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচয় করানোই প্রধান উদ্দেশ্য এই উৎসবের।” সবমিলিয়ে এ-যেন গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজোর আয়োজন…
Powered by Froala Editor