ভাড়া পাওয়া যায় বইও, কলকাতার ‘অজানা’ দোকানগুলি পাঠকের খিদে মেটাচ্ছে এভাবেই

ধরুন, কোনো বই পড়তে খুব ইচ্ছে করছে আপনার। অথচ দাম দেখে আঁতকে উঠলেন। কেনার সামর্থ্য নেই। কিংবা, বাড়িতে নতুন বই রাখার জায়গাও সীমিত। পাড়ার লাইব্রেরিতে নেই বইটি। কিন্তু তা বলে পড়ার ইচ্ছে মেরে ফেলবেন? কী দরকার! বরং বইটা ভাড়া নিয়ে আসুন, পড়ে আবার ফেরত দিয়ে দিন দোকানিকে। পড়ার খিদেও মিটল, খরচও হল না বেশি। ভালো উপায় না?

শুনে অবাক হতেই পারেন। বই ভাড়া! তা আবার হয় নাকি! বই কেনা যায়, বন্ধুর থেকে ধার নেওয়া যায়, এমনকি লাইব্রেরি থেকেও আনা যায় চাইলে। কিন্তু বই ভাড়া পাওয়া যায়! তাও আবার খোদ কলকাতায়! শুনে অবাক হওয়ারই কথা। অবাক হয়েছিলাম আমরাও। কিন্তু নিজের চোখে দেখে সন্দেহ ঘুচল। হ্যাঁ, এই মহানগরীর বুকেই আছে এমন ঠিকানা। ইচ্ছেমতো বই ভাড়া নিয়ে, পড়ে, আবার ফেরত দেওয়ার সুবিধা।

গড়িয়াহাট উড়ালপুল থেকে নেমে গোলপার্কের দিকে যেতে যেতে, হঠাৎ ডানদিকে চোখে পড়ে ফুটপাথ জুড়ে সার সার পুরনো বইয়ের দোকান। প্রায় বারো তেরোটি দোকান পরপর পসরা সাজিয়ে বসে গেছে। যেন মিনি কলেজ স্ট্রিট। থাকে থাকে সাজানো প্রচুর বই ও ম্যাগাজিন। কী নেই সেই তালিকায়!  দান্তে থেকে দস্তয়েভস্কি, মার্ক্স থেকে মার্কেজ,  রাস্কিন বন্ড থেকে জেমস্ বন্ড কোনো কিছুই বাদ নেই। তবে বেশিরভাগই ইংরেজি বই। তার মধ্যে এক কোণে কুন্ঠিত হয়ে উঁকি মারছে শরৎ বা বঙ্কিমের কোনো বই।

ঘুরতে ঘুরতে হাজির হওয়া গেল সেখানকার সবচেয়ে বড়ো দোকানটিতে। প্রায় একতলা বাড়ির সমান উঁচু বইয়ের পাহাড় এখানে। 'মালগুড়ি ডেজ', 'নেমসেক', 'জাপানিজ ওয়াইফ', 'গান আইল্যান্ড'-এর মতো অসংখ্য বই থরে থরে সাজানো। দোকানের এককোণে বসে আছেন দোকানের মালিক, নাম নিতাই দাস। তাঁর সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে বলতে জানা গেল, তিনি শুধু বই বিক্রিই করেন না, বই ভাড়াও দিয়ে থাকেন। 

এখনকার প্রজন্মের কাছে খবরটা নতুন হলেও, প্রায় দুদশক আগে পর্যন্ত এই গড়িয়াহাট অঞ্চলে অনেকগুলি দোকানই বই ভাড়া দিত। এই অঞ্চলের পুরনো বাসিন্দাদের কাছ থেকে তাও শোনা গেল। নিতাইবাবুর কথায়, "আগে অনেক লোক আসত বই ভাড়া নিতে, তবে অনলাইনে বই আসার পর থেকে অনেকেই আর আসে না।"

নিতাইবাবু জানালেন, তিরিশ থেকে পঞ্চাশ-ষাট টাকার মধ্যে বই ভাড়া দিয়ে থাকেন তিনি। বইয়ের ভাড়া সাধারণত নির্ভর করে বইয়ের দাম ও দৈর্ঘ্যের উপর। অবশ্য সঙ্গে একশো থেকে দুশো টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিটও নেন, যা বই ফেরত দিলেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় প্রতি দিনই কেউ না কেউ বই ভাড়া নিতে আসে। তাদের মধ্যে যেমন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আছে, রয়েছেন বয়স্ক মানুষরাও। গল্পের বই নিলেও, কবিতার বইয়ের চাহিদা কম। তাই দোকানেও কবিতার বই দুর্লভ।

নিতাইবাবুর দোকান থেকে বেরিয়ে আরো দু-একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বই ভাড়া দেন তাঁরাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়,খুব কম সংখ্যক মানুষই তার খোঁজ রাখেন। পুরোনো বই বিক্রির পসারও আস্তে আস্তে কমে আসছে। মানুষ এখন বেশি অনলাইনেই বই কিনছে। এরকম নানা কথা কানে আসছিল ফিরে আসার পথে।

অন্ধকার নেমে গেছে অনেকক্ষণ। দোকানে দোকানে আলো জ্বলে উঠেছে। মানুষের ভিড় আরও বেড়েছে। দলে দলে তরুণ তরুণীরা হেঁটে যাচ্ছে লেকের দিকে। কেউ কেউ হয়তো বা অদূরের লাইব্রেরিতে। কিন্তু কতজন এই সব দোকানের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে? কজনই বা খোঁজ রাখছে যে, এই দোকানগুলোও এক-একটি মিনি লাইব্রেরি? বই ভাড়া দেওয়ার এক অভিনব ঠিকানা পিছিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। পথ এগোচ্ছে। পাঠক পিছিয়ে পড়ছেন না তো?

Latest News See More