চলতি বছরের মার্চ মাসে করোনা ভাইরাসের ছায়া গাঢ় হতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থনীতির চাকাও আক্ষরিক অর্থে বিশবাঁও জলে ডুবে গেছে গোটা দেশের। কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত রকম পরিবহন পরিষেবাও প্রায় বন্ধ থাকায় ঘাটতি দেখা গিয়েছে যোগানেও। বহু মানুষের রাতারাতি কর্মহীন হওয়ার খবর এসেছে সামনে। চাকরি না হারালেও বেতন ঘাটতির সম্মুখীনও হয়েছেন বহু মানুষ। সাম্প্রতিক সমীক্ষাতেও সামনে এসেছে দেশের প্রায় সকল অর্থনৈতিক শ্রেণীর রোজগার ঘাটতির বিষয়টি। ফলে বাজারে এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি। তার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে দফায় দফায় পেট্রোলের দাম বৃদ্ধি। অদ্ভুতভাবে এই বিপর্যস্ত সময়ে উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে নীরব থেকেছে কেন্দ্র এবং লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি যেভাবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়েও কোনও সদর্থক পদক্ষেপ দেখা যায়নি কেন্দ্রের তরফে।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেছেন এই সময়ে খোলাবাজারে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলির দাম বেঁধে দেওয়া আবশ্যক ছিল, অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় ‘প্রাইস সিলিং’। কিন্তু সেসব রাস্তায় না হেঁটে লাগাতার লকডাউন এবং হঠাৎ করেই আবার আনলক প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়ায় একদিকে যেমন বেড়েছে বিভ্রান্তি, তেমনই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণেও রাশ টানা যায়নি। ফলে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলি এখনও সচল না হওয়ায় কবে এই দুর্দশা কাটবে তা নিয়ে বেশ আশঙ্কায় দেশের অর্থনৈতিক মহল।
অবশ্য এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়ার নামে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং কেন্দ্রীয় সরকার একগুচ্ছ ঘোষণা যদিও করেছিল, কিন্তু আদতে তার প্রতিফলন কতটা দেখা গিয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকছেই। কারণ দেশের সর্বোচ্চ ব্যাঙ্ক একপ্রকার স্বীকার করেই নিয়েছে যে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম ক্রমশ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর সঙ্গেই বাংলার মতো রাজ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় আমফানের দাপটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরে কেন্দ্রীয় সাহায্য প্রয়োজন ছিল অনেকটাই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে শাক-সব্জি থেকে শুরু করে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের দাম। একদিকে কর্মহীনতা, কর্মক্ষেত্রের সংকোচন এবং রোজগারে ঘাটতি, অন্যদিকে এই লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে দেশের জনগণের। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হবার সম্ভাবনা থাকলেও খবরের শিরোনামে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের দল পুনরায় যেনতেন মূল্যে ফিরতে চাইছেন কর্মক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে বক্তব্যটা সাফ, পেটে কিল মেরে বেঁচে থাকার চেয়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো!
অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আনলক পর্বে গ্রামীণ এলাকায় কৃষি এবং ছোটখাটো শিল্পোৎপাদনের হার বৃদ্ধি পেলেও ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এর জন্য আর্থিক প্যাকেজ একান্তই প্রয়োজন ছিল। এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি বলেও কার্যত স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষেই দেশের মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার করোনা ভাইরাসের আক্রমণকে দায়ী করলেও, দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের অপরিকল্পিত পদক্ষেপই যে এর জন্য মূলত দায়ী, সে কথা হয়তো তাই আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। বহু বিতর্কিত ‘নোটবন্দি’র ধাক্কাও যে এখনও অর্থনীতি সামলে উঠতে পারেনি, সে বাস্তবও সামনে চলে আসছে বারবার। বর্তমান সময়েও কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়াই আচমকা লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়াতেও যে ঘটেছে বিপত্তি, তাতেও সহমত বিশেষজ্ঞরা।
এই লকডাউন পর্বেই আচমকা বাজারে ‘ডিম্যান্ড ক্রাইসিস’ তৈরি করে দেওয়ায় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়েছে অর্থনীতির সাধারণ নিয়মেই। অর্থনীতির বেহাল অবস্থায় সরকারি প্রকল্পগুলিকেও বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে। কিন্তু এইভাবে আদতেই এই বিপদ সামাল দেওয়া যাবে কিনা, প্রশ্ন উঠেছে সব মহলেই। তাই দেশের উন্নয়নের গতি যখন প্রায় থমকে, তখন সাম্প্রতিক অন্যান্য খরচের যৌক্তিকতা কতটা ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয় কি? প্রশ্ন কিন্তু উঠছেও...
আরও পড়ুন
টানা দু’সপ্তাহ ধরে দেশের গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে বেকারত্বের হার
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor