নিশ্চিত পদক ছেড়ে জিতিয়ে দিয়েছিলেন সহ-প্রতিযোগীকে, সততার বিরল উদাহরণ ইভান

আর মাত্র মিটার বিশেক দূরত্ব। তারপরই ফিনিশিং লাইন। এমন সময়ই হঠাৎ গতি কমিয়ে দিলেন প্রথম স্থানে থাকা কেনিয়ার অ্যাথলিট অ্যাবেল মুতাই। স্পষ্টতই তাঁর চেহারায় ফুটে উঠল উদযাপনের ভঙ্গি। আসলে যে জয় আসেনি এখনও তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি অ্যাবেল। মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ দর্শকরা। তাঁরাও যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না এই ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যেও চিৎকার করে উঠলে একজন। তিনি আর কেউ নন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা স্প্যানিশ প্রতিযোগী ইভান ফার্দিনান্দ আনায়া। বার বার সতর্ক করলেন রেস শেষ হয়নি এখনও। কিন্তু কাজ হল না তাতে। মুতাই যে স্প্যানিশ ভাষা বোঝেন না! অগত্যা মুতাইকে ধাক্কা দিয়ে ফিনিশিং লাইন পার করিয়ে দিলেন তিনি।

২০১২ সাল। সদ্য শেষ হয়েছে লন্ডন অলিম্পিক। সেই অলিম্পিকে ৩০০০ মিটার ম্যারাথনে ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে এসেছিলেন কেনিয়ান স্প্রিন্টার মুতাই। আর তার ঠিক পর পরই ঘটেছিল এই ঘটনা। দিনটা ছিল ১২ ডিসেম্বর। স্পেনের বুরদালায় সেবার বসেছে ক্রস কান্ট্রি রেসের আসর। প্রতিযোগিতার শুরু থেকেই ফেভারিট ছিলেন মুতাই। একপ্রকার নিশ্চিত ছিল তাঁর পদকজয়। তবে সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য ফিনিশিং লাইনের আগেই থেমে যান তিনি। তারপর যা ঘটেছিল, সেই ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে আগেই।

আসলে সাধারণ রেসের সঙ্গে সামান্য চারিত্রিক পার্থক্য রয়েছে ক্রস কান্ট্রি রেসে। সেখানে দৌড়ের শেষ দশ মিটার সাধারণ ট্র্যাকের বাইরে থাকে। এই অংশটুকু দৌড়াতে হয় ব্যারিকেড ঘেরা ঘাসের মাঠে। সেই জায়গাটাতেই ভুল করে ফেলেছিলেন মুতাই। আগে এই ধরনের রেসে দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা না থাকায়, ফিনিশিং লাইনে পৌঁছানোর আগেই শুরু করে দিয়েছিলেন উদযাপন। ভেবেছিলেন ইতিমধ্যেই জয়ী হয়েছেন তিনি।

মুতাইয়ের সঙ্গে তখন দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ইভানের দূরত্ব আরও মিটার দশেক। অনায়াসেই মুতাইকে পেরিয়ে জয়ী হতে যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু নিশ্চিত পদক জেতার সুযোগ হাতছাড়া করেই এমন মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন স্প্যানিশ রানার। আর তাঁর এই কর্মকাণ্ডের জেরে ‘রানার্স আপ’ হয়েও হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন বিশ্ববাসীর। 

আরও পড়ুন
হতাশায় ছাড়তে চেয়েছিলেন খেলাও, ঘুরে দাঁড়িয়েই পদকজয়ী মণিপুরের ‘রুপোর মেয়ে’

প্রতিযোগিতার পরে প্রেস কনফারেন্সে তিনি জানিয়েছিলেন, গোটা রেসিং ট্র্যাক জুড়ে শুরু থেকেই রাজত্ব করেছেন মুতাই। আর তাঁর ভুল বোঝার সুযোগ নিয়ে যদি তিনিই প্রথম হতেন, তবে তা নৈতিক হত না। এমন জয়ে স্বর্ণপদক পেলেও মায়ের কাছে মুখ দেখাতে পারতেন না তিনি। 

আরও পড়ুন
অলিম্পিকের প্রথম একক পদকজয়ী ভারতীয়, পেনশনের অভাবে কেটেছে শেষ জীবন

ক্রীড়াঙ্গনে এহেন ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটতে দেখা যায় কোথাও। স্পেন তো বটেই, এই ঘটনার রেশ পড়েছিল ভারতেও। ইভানের এই মানবিকতার দৃশ্য শিক্ষার্থীদের বড়ো স্ক্রিনে দেখিয়েছিলেন দক্ষিণের এক শিক্ষিকা সুমিতা কৃষ্ণা। তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে পরবর্তীতে একাধিক স্কুল ও কলেজে দেখানো হয় এই দৃশ্য।

আরও পড়ুন
নিশ্চিত পদক খুইয়েও দুই প্রতিযোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই অলিম্পিয়ান

তবে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হলেও, কোচের রোষ থেকে মুক্তি পাননি ইভান। ইভানের প্রশিক্ষক ছিলেন পেশাদার অ্যাথলিট মার্টিন ফিজ। এই ঘটনার পর এক হাত নিয়েছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মার্টিন। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, ইভান ভালো মানুষ হলেও ভালো অ্যাথলিট নন। একজন পেশাদার অ্যাথলিটের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত জয় নিশ্চিত করা। আর সেখানে সর্বাঙ্গে পিছিয়ে রয়েছেন তাঁর শিষ্য।

দুঃখের বিষয় ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ হাত ছাড়া হওয়ার পর আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি ফার্নান্দেজ। পরবর্তীতে ২০১৬-র অলিম্পিকের স্প্যানিশ দল থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। তবে আজও সেই ঘটনার জন্য এতটুকু হতাশ নন তিনি। নেই আক্ষেপও। ইভানের এই সততার উদাহরণ এককথায় সত্যিই অবিশ্বাস্য! 

Powered by Froala Editor

Latest News See More