ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রঘুনন্দন পাহাড়। আর এই পাহাড়পজুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র পাথরের মূর্তি। শুধু মূর্তি বললে ভুল হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেবদেবীদের ছবি। কোনোটি প্রমাণ আকারের, কোনোটির উচ্চতা আবার কমপক্ষে ৩০ ফুট।
ঊনকোটি (Unakoti)। ত্রিপুরার (Tripura) রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত এই আশ্চর্য প্রত্নক্ষেত্র পরিচিত এই নামেই। আর এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এই প্রত্নক্ষেত্রের রহস্য। ‘ঊন’ কথাটি ব্যবহৃত হয় কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণের থেকে এক কম বোঝাতে। অর্থাৎ, ঊনবিংশ বলতে আমরা বোঝাই বিংশ বা কুড়ির থেকে এক কম। ঠিক তেমনই ‘ঊনকোটি’ শব্দটির অর্থ কোটির থেকে এক কম। অর্থাৎ, নিরানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার নশো নিরানব্বই। পুরাণ ও লোককথা অনুযায়ী সবমিলিয়ে রঘুনন্দন পাহাড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সমসংখ্যক দেবদেবীর মূর্তি। আর সেই কারণেই এই নামের উৎপত্তি। অবশ্য সত্যিই এই প্রত্নক্ষেত্রে ঊনকোটি মূর্তি রয়েছে কিনা— তা নিশ্চিত নয় আজও। তবে সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই লক্ষাধিক। কিন্তু কবে তৈরি হয়েছিল এই আশ্চর্য ভাস্কর্যগুলি? কে-ই বা তৈরি করেছিল সেগুলি?
এ-নিয়ে প্রচলিত রয়েছে দুটি ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি। প্রথম কাহিনি অনুযায়ী, একসময় ত্রিপুরার এই পাহাড়ে বসবাস করতেন কালু কামার নামের এক স্থাপতি ও ভাস্কর। এই সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছেন তিনিই। এবং তাঁকে এই শিল্প সৃষ্টির আদেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব। পুরাণ অনুযায়ী, মহাদেব ও পার্বতীর ভক্ত ছিলেন কালু। মহাদেব ও পার্বতীর কৈলাসযাত্রার যাওয়ার সময়, তিনি বায়না ধরেন, তাঁকেও নিয়ে যেতে হবে কৈলাসে। সে-সময় নাকি শিব শর্ত রেখেছিলেন এক রাতের মধ্যে এক কোটি দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করলেই তিনি সঙ্গে নেবেন তাঁকে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ঊনকোটি মূর্তি তৈরি করেই থামতে হয়েছিল কালু কামারকে। ততক্ষণে ফুটে যায় সূর্যের আলো। আর কৈলাস যাওয়া হয়নি তাঁর।
আবার ভিন্ন একটি লোকগাথা অনুযায়ী, দেবাদিদেব এই পথে বারানসি পাড়ি দেওয়ার সময় এক রাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন এই পর্বতে। সঙ্গে ছিলেন আরও ঊনকোটি দেবদেবী। অথচ, সকালে মহাদেবের ঘুম ভাঙলেও, ক্লান্তিতে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে থাকেন বাকি দেবদেবীরা। তাঁদের ঘুম ভাঙাতে না পেরে, শেষে একাই বারানসি রওয়ানা দেন শিব। অন্যদিকে ঊনকোটি দেবদেবী তাঁর রোষে পাথর হয়ে সেঁধিয়ে যান পাহাড়ের গায়ে।
অবশ্য রঘুনন্দন পাহাড়ে গেলে শিবেরও মূর্তিও দেখা যাবে দিব্যি। জটাধারী শিব, কালভৈরব, নটরাজ, পশুপতি-সহ মহাদেবের একাধিক রূপের প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে ঊনকোটিতে। সেইসঙ্গে রয়েছে গণেশ, দুর্গা, বিষ্ণু, রাম, রাবণ, হনুমান, শৈববাহন নন্দী, লক্ষ্মী-নারায়ণের মূর্তিও। অন্যদিকে ঊনকোটির প্রধান আকর্ষণ হল গণেশকুণ্ড। তিনটি পাহাড়ি ঝর্ণার ধারা এসে মিলিত হয় এই কুণ্ডে। কুণ্ড সংলগ্ন পাথরের দেওয়ালে রয়েছে তিনটি গণেশ মূর্তিও।
ঐতিহাসিকদের মতে আনুমানিক অষ্টম কিংবা নবম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল এই ভাস্কর্যগুলি। অবশ্য সেগুলি কে বা কারা তৈরি করেছিলেন, সে-ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট তথ্য উঠে আসেনি গবেষণায়। কোনো ঐতিহাসিক নথিতেও উল্লেখ নেই এই আশ্চর্য শিল্পকর্মের। অবশ্য এই মূর্তিগুলির সঙ্গে মিল রয়েছে মঙ্গোলয়েড শিল্পকর্মের। বিশেষ করে কম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাট মন্দিরের ধারা ও মঙ্গল ধারাকে মিশিয়েই যেন নির্মিত হয়েছিল এই আশ্চর্য ভাস্কর্য। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের আঙ্কোরভাট’ নামেও পরিচিত ঊনকোটি। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এখানেই একসময় বসবাস করতেন শিব। এমনকি শিবরাত্রি এবং সংক্রান্তিতে তিনি প্রতিবছর ঘুরে যান এই পবিত্র স্থানে। ফলে, বিশেষ বিশেষ তিথি উপলক্ষে মেলাও বসে ঊনকোটির প্রাঙ্গণে।
স্থানীয়দের কাছে পরিচিত হলেও, বিশ শতকেরও শুরুর দিকে এক ইংরেজ ঐতিহাসিকের হাত ধরেই বিশ্ববাসীর কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ঊনকোটি। তারপর কেটে গেছে প্রায় একশো বছরের বেশি সময়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কোর অস্থায়ী ‘হেরিটেজ তালিকা’-তেও জায়গা পেয়েছে এই ঐতিহাসিক স্থান। তবে তারপরেও রহস্যের মেঘ কাটেনি ঊনকোটির উপর থেকে…
Powered by Froala Editor