এ এক অন্য ফিরে আসার গল্প, অথবা এক অন্য যাত্রা শুরু, যে পথ অন্ধকার থেকে নিয়ে যায় আলোর দিকে। যুদ্ধ-হিংসা আর মৃত্যুর মিছিল পেরিয়ে যে পথের শেষে গান বাজতে থাকে, ‘জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’।
বেশ কয়েক দশক ধরে দেশের সুরক্ষার কাছে বড়সড় ‘থ্রেট’ ছিল ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম বা আলফা। সেই আলফার একনিষ্ঠ সৈনিক ছিলেন তিনি, মণি মানিক গগৈ। যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৮৮ সালে আলফায় যোগদান করার প্রায় এক দশক পরে, ১৯৯৮ সালে ভারতীয় সেনার হাতে ধরা পড়েন তিনি। এক বছরের জন্য কারাদণ্ডের সাজা হয় তাঁর। কিন্তু তারপর আর ফেরত যাননি আলফাতে। নিজের গ্রাম তিংখানে ফিরে এসে সামাজিক কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দেন নিজেকে।
কৈশোরে বেড়ে ওঠার সময়টায় নিজের চারপাশে অসহ্য দারিদ্রতা দেখেছেন মানিক। অথচ তাঁর কথায়, যে শহরটায় তাঁরা বেড়ে উঠে ছিলেন, তাতে প্রাচুর্যের কমতি ছিল না কোনও। চা বাগান, তেলের খনি থাকা সত্ত্বেও সাধারণ গরিব মানুষের জন্য কোনও রকম সুযোগ-সুবিধা ছিল না। রাস্তা নেই। চাকরি নেই। অভাবের তাড়নায় কোনও কোনও সময় রাস্তায় ভিক্ষাও করতে হয়েছে তাঁর মাকে। এই বঞ্চনা এবং অপ্রাপ্তির অন্ধকার থেকেই উগ্রবাদী সংগঠনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল সেই সময়কার আসামের তরুণ সম্প্রদায়। যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। শিখে নিয়েছিল গেরিলাযুদ্ধের আদব-কায়দা।
তবে বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির কাছাকাছি ফিরে যান এই আলফা নেতা। যেন চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে উত্তরণের গল্প। অর্থের সংস্থান করে নিজ উদ্যোগে তৈরি করেন কৃষিভিত্তিক খামার, যেখানে কাজে যোগ দেয় শয়ে শয়ে গ্রামীণ যুবক। কাঁচা রাস্তার বদলে তৈরি হয় পাকা রাস্তা। শুরু হয় বনসৃজনের কাজ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে তৈরি হয় ব্রিজ। স্থানীয় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য যাতে বাইরে না যেতে হয়, তার জন্য নতুন স্কুল।
গগৈ বলছেন সমস্ত গ্রামবাসীরাই তাঁর এই উন্নয়ন যজ্ঞে সামিল। তার কারণ হয়তো তিনি কখনোই এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের থেকে আলাদা চোখে দেখেননি। তিনি দেখেননি কে মারোয়াড়ি, কে নেপালি বা হিন্দু বা মুসলিম।
২০০৩ সালে তিনি গড়ে তোলেন তিংখান কলা কেন্দ্র। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নাচ, গান, নাটক বা আঁকা শেখানোর জন্য তার এই শিক্ষা কেন্দ্রের অন্যতম প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন তিনি নিজেও। ছোটদের তিনি শেখাতেন মহাত্মা গান্ধীর প্রতিকৃতি আঁকতে, যাঁকে নিজের গুরু হিসেবে মনে করতেন তিনি।
আলফার তুলকালামের দিনগুলোতেই সহযোদ্ধা দীপালিকে বিয়ে করেন মানিক। তাঁর সহধর্মিনী এখানেও তাঁর সঙ্গে এই যুদ্ধে সামিল। বর্তমানে গগৈ দম্পতি ব্যস্ত আসামের বৃহত্তম ইকো ট্যুরিজম প্রজেক্ট নিয়ে। তাঁদের এই স্বপ্ন সত্যি হলে মেরবিল লেক ঘিরে গড়ে উঠবে এই প্রকৃতিবান্ধব ভ্রমণব্যবস্থা। কাজ পাবে গ্রামের মানুষেরাই। প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে আরও একবার হিংসা ভুলে মানুষকে আপন করে নিতে শিখব হয়তো আমরাও।