দুর্গাপুজোর দিনেও ইউজিসি নেট! সম্প্রতি কেন্দ্রের তরফে যে পরীক্ষার সূচি ঘোষণা করা হয়েছে, তা অনুযায়ী পুজোর পঞ্চমী, ষষ্ঠী ও সপ্তমীর দিন পড়েছে ইউজিসি-নেটের পরীক্ষা। পরীক্ষা চলবে ২৪শে সেপ্টেম্বর থেকে ৫ই নভেম্বর পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষার সূচি ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। বিরোধিতা শুরু হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন আরও জোরদার হবে। ফুঁসে উঠেছে বাংলার বিভিন্ন সংগঠন ও বিশিষ্টজনেরাও। এই ঘটনাকে বাংলার ছাত্র ও সংস্কৃতির প্রতি কেন্দ্রের অসম্মান হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠে গেছে, ক্রমশই কি বাঙালি বিদ্বেষ প্রকট হচ্ছে? কেন্দ্রের একের পর এক সিদ্ধান্তে কিন্তু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে অনেকটা সেই রকমই। ইতিমধ্যেই যে জুন/সেপ্টেম্বর সেশনের ইউজিসি নেট পরীক্ষার সময় সূচি প্রকাশিত হয়েছে, তা সেই বিতর্কে ইন্ধন দিয়েছে আরও। নয়া সময়সূচি দেখে বিভ্রান্তি চরমে উঠেছে বাংলার তাবৎ ছাত্রছাত্রীদের। কারণ পরীক্ষা যে পড়েছে বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর মধ্যেই।
শারদোৎসব দুর্গাপুজো যে পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে পালিত হয়, তা অজানা নয় দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মানুষদের কাছেও। নেহাৎ একটি পুজোই নয়; বরং এর তাৎপর্য ছড়িয়ে আছে সমাজের অন্যান্য স্তরেও। সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের অপরূপ নিদর্শন তৈরি হয় পুজোর কয়েকটি দিনকে ঘিরে। তা সত্ত্বেও কেন কেন্দ্র এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। বাংলার সংস্কৃতি এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি কেন্দ্রের অবজ্ঞা ধীরে ধীরে কি তাহলে গভীর হচ্ছে আরও? প্রশ্ন উঠে গেছে ইতিমধ্যেই। স্বাভাবিকভাবেই এই পরীক্ষা ঘিরে আবারও তৈরি হয়েছে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সংঘাতের আবহ।
সম্প্রতি জেইই-নিট পরীক্ষা নিয়ে কেন্দ্রের একগুয়েমির বিরুদ্ধে আপত্তি করতে দেখা গিয়েছিল বেশকিছু বিরোধী দলকে। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে পরীক্ষা স্থগিত করার দাবি জানিয়েছিল বিরোধী দলগুলি। কিন্তু স্বভাবগত ভাবেই বিরোধীদের সমস্ত দাবিকে উপেক্ষা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। করোনা পরিস্থিতিতে জেইই ও নিট পরীক্ষা স্থগিতের দাবিতে বিরোধী দলগুলি একত্রিত হয়ে প্রধান আদালতে দরবার করার পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছিল। এমনকি করোনা পরিস্থিতিতে পড়ুয়াদের পরীক্ষার সিদ্ধান্ত বদলের আর্জি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একাধিকবার চিঠি লিখেছিলেন বলেও জানিয়েছিলেন স্বয়ং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। শুধুমাত্র তাই নয়, দেশজুড়ে ছাত্রছাত্রীরাও প্রতিবাদ জানানো শুরু করেছিল এর বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো কথাই ঢোকেনি কেন্দ্রের কানে। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে সব আন্দোলন, প্রতিবাদ উপেক্ষা করার নীতি যে এই সরকার ভালোই রপ্ত করেছে, তা সুতরাং বলাই বাহুল্য।
স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করেছে, দুর্গাপুজো শুধুমাত্র বাঙালির উৎসব নয়। এর গরিমায় এবং আবেদনে বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে। তাছাড়াও স্বাভাবিকভাবেই যদি চিন্তা করা যায়, তাহলেই বুঝতে পারা যাবে পুজোর সময় পরীক্ষা গ্রহণের সমস্যাগুলো ঠিক কোথায়। দুর্গাপুজোর আগে থেকেই রাস্তায় কি পরিমাণ মানুষজনের ভিড় লেগে থাকে তা এখন অজানা নয় কারোর কাছেই। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই যানবাহনে জায়গা সংকুলান করা সমস্যার বিষয় হয়ে ওঠে। সেখানে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির জন্য এখনও স্বাভাবিক হয়নি যানবাহন চলাচল। লোকাল ট্রেন পরিষেবা কবে থেকে শুরু হবে, সেই ব্যাপারে কেন্দ্র নিজেই এখনও কোনও লক্ষ্যমাত্রা দিতে পারেনি। সুতরাং তার মধ্যেই যদি পরীক্ষা হয়, তাহলে কীভাবে পরীক্ষার্থীরা যাতায়াত করবেন তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।
এছাড়াও পুজোর দিনগুলিতে চারপাশে যেভাবে শব্দব্রহ্ম তৈরি হয়, তারমধ্যে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা গ্রহণ করা আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা সেই ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠছে। তার থেকেও আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, পরীক্ষার দিনক্ষণ ঠিক করার আগে নির্ধারক সংস্থা একবারও এই বিষয়গুলির কথা ভাবলেন না?
আরও পড়ুন
ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের আর্জি কেন্দ্রের, অপপ্রচার আটকানোর আড়ালে কি বিরোধীদের কণ্ঠরোধ?
সবকিছুর পরে তাই উঠে আসছে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বিতর্কিত বিষয়টি। সাম্প্রতিককালে বেশকিছু ইস্যুতেই কেন্দ্রের বাঙালি বিদ্বেষী রূপ বেরিয়ে এসেছে বারবার। রাজ্যকে জিএসটির ভাগ দেওয়া থেকে শুরু করে দুর্যোগের মোকাবিলায় অনুদান, কোনোটিতেই কেন্দ্রের আনুকূল্য পায়নি বাংলা। সুপার সাইক্লোন আমফানের তাণ্ডবে রাজ্যের একাধিক অঞ্চল তছনছ হয়ে গেলেও মুখ ফিরিয়ে থেকেছে কেন্দ্রীয় সরকার। হাজার তদবির করেও একে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করানো যায়নি। লকডাউন পরিস্থিতিতে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতিও বিমাতৃসুলভ আচরণ চোখে এসেছিল। এছাড়াও জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধ্রুপদী ভাষার তালিকায় অদ্ভুতভাবে বাদ পড়েছিল বাংলা ভাষা। এমনকি একাধিক সরকারি-বেসরকারি মিডিয়াতে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীরা এবং শাসক দল ঘনিষ্ঠ মানুষেরা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন যে, বাংলা ভাষার আদতে কোনও ঐতিহ্যই নেই! কেন্দ্রের বর্তমানে সিদ্ধান্ত আরও চাগিয়ে দিল সেই বিতর্ক।
কথা হচ্ছে, রাজনীতিকদের রাজনীতি করতেই হবে। এই সহজ সত্যটা এখন আর মেনে নিতে অসুবিধা নেই কারোরই। কিন্তু রাজনীতির মূল বিষয়টি তো হল মানুষ। সেই সাধারণ জনগণকেই উপেক্ষা করে, একের পর এক জনবিরোধী নীতি অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ঠিক কি উচ্চমানের রাজনীতি হচ্ছে, সেটা নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে সাধারণ মানুষদেরই। ভুললে চলবে না, জনপ্রতিনিধি অথবা শাসক বেছে নেওয়ার দায়ভার কিন্তু এই গণতন্ত্র দিয়েছে সাধারণ মানুষকেই। তাই ঠিক কোন ঔদ্ধত্যে কেন্দ্রীয় সরকার একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষদের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করে চলেছে, তার জবাব চাওয়ার সময় কিন্তু এবার এসেছে। বাংলার তাবৎ ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। অন্ততপক্ষে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে, নিদেনপক্ষে নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে এই সংকীর্ণ রাজনীতি ঊর্ধ্বে ওঠা যেত না কি?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুন
লকডাউনে খাদের কিনারায় দলিত, মুসলিম এবং আদিবাসীরা, পৌঁছোয়নি ত্রাণও; প্রকাশ সমীক্ষায়
Powered by Froala Editor