সাল ১৯২৩। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা গেলেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল প্রতিভা সুকুমার রায়। সদ্য জন্ম নিয়েছে তাঁর পুত্র, সত্যজিৎ। কিন্তু কী এমন রোগ অকালে কেড়ে নিল তাঁর প্রাণ? পাঠকরা সহজেই বলে দেবেন সেই উত্তর— কালাজ্বর। শুধু সুকুমার রায় নন, বাংলার গ্রামে গ্রামে তখন এই রোগটি বাসা বেঁধেছিল প্রবলভাবে। যখন উপদ্রব শুরু হত, তখন সবাইকে ছারখার করে দিত। কিন্তু কেউই এর থেকে নিরাময়ের রাস্তা পাচ্ছিল না। হয়ত পেতে আরও দেরি হত; যদি ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী নামক ভদ্রলোক না থাকতেন।
সুকুমার রায় যখন মারা যান, তখন অবশ্য কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়ে গেছে। ক্যাম্পবেল হাসপাতাল, অধুনা এনআরএস হাসপাতালের ছোট্ট একটি ঘরে বসে নিজের গবেষণার কাজে মগ্ন থাকেন উপেন্দ্রনাথ। সারা বাংলা কালাজ্বরের আক্রমণে মরিয়া, তাঁদের বাঁচাতে হবে তো! ১৯১৫ সাল থেকে তাঁর গবেষণার কাজ শুরু হয়। পরিকাঠামো সেরকম ছিল না। অনেক কষ্টে, কৃচ্ছসাধন করে নিজের গবেষণা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তখন এনআরএসের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। আগে যে ওষুধটি ব্যবহার করা হত, সেটি ছিল সোডিয়াম অ্যান্টিমনি টারটারেটের সঙ্গে আর্সেনিক, কুইনাইন-সহ আরও বেশ কিছু পদার্থের মিশ্রণ। খুব একটা কার্যকরী ছিল না এটা।
এখান থেকেই নিজের গবেষণা শুরু করলেন উপেন্দ্রনাথ। ওই মিশ্রণ থেকে সোডিয়াম পৃথক করে, তার সঙ্গে ইউরিয়া আর অ্যান্টিমনির সংযোগ ঘটানো হল। তৈরি হল ইউরিয়া স্টিবামিন। তিনটে রোগাক্রান্ত খরগোশের দেহে প্রয়োগ করেন এটি। অতঃপর, ইউরেকা! সফল হল তাঁর গবেষণা। ওই ছোট্ট কক্ষে বসে কালাজ্বরকে হারাতে সক্ষম হলেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। বিশ্ব মুক্তি পেল একটি মহামারীর হাত থেকে।
অথচ, এই অভূতপূর্ব আবিষ্কারের পরেও নোবেল পেলেন না উপেন্দ্রনাথ। ১৯২৯ সালে প্রথম মনোনয়ন, নোবেলের জন্য। পরে আরও কয়েকবার। কিন্তু পুরস্কার পাওয়া হল না। তাঁকে কি 'যোগ্য' মনে করেননি নোবেল কমিটির বিচারকরা? নাকি পরাধীন দেশের 'নেটিভ' চিকিৎসক হওয়ায় এই বঞ্চনা? কে দেবে এই উত্তর?
আরও পড়ুন
সেবার নোবেলের দাবিদার মহাত্মাও; তাঁর মৃত্যুতে বাতিল হল নোবেল শান্তি পুরস্কারই
দ্বিতীয় ঘটনাটি তারও বেশ কয়েক বছর আগেকার। উনবিংশ শতকের শেষের দিক। ভারতে ইংরেজদের আধিপত্য তখন রমরমিয়ে। কলকাতার পিজি হাসপাতালে (এসএসকেএম হাসপাতাল) যোগ দিয়েছেন এক ইংরেজ সাহেব। সেকেন্দ্রাবাদ হয়ে এই শহরে এসেছেন তিনি। তিনি ডাক্তার; কিন্তু তার পাশে আরও একটি লক্ষ্য রয়েছে তাঁর। ম্যালেরিয়াকে পরাজিত করতে হবে। ছোটবেলায় নিজের বাবাকে এই রোগে কাবু হতে দেখেছেন। কাজেই এই রোগের ঠিকুজি কোষ্ঠী জানতে হবে তাঁকে। ততদিনে এটা জানা গেছে, মশার কামড়েই এমন রোগ হয়। কিন্তু কোন মশা? কীভাবে ছড়ায় এই রোগ? প্রাণপণে লেগে পড়লেন রোনাল্ড রস…
পিজি হাসপাতালের ছোট্ট একটি ঘর। সেরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। ওই পরিকাঠামোতে এমন গবেষণা করা যে কোনোমতেই সম্ভব নয়! কিন্তু রোনাল্ড রস তো হারবেন না। শত কষ্ট হোক, রোগের গভীরে ঢুকবেন তিনি। মশার দেহ ব্যবচ্ছেদ শুরু করলেন। একটাকে ব্যবচ্ছেদ করেন, তারপর চোখ চলে যায় মাইক্রোস্কোপে। লক্ষ্য, পাকস্থলীর কোষ। ওখানেই থাকবে রহস্যের সন্ধান। কিন্তু বারবার খোঁজার পরও কিছুই হচ্ছিল না। ক্রমশ ব্যর্থ হচ্ছিলেন। ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন রোনাল্ড রস। এমন সময় মিলল কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। একটি বিশেষ প্রজাতির মশার দেহে মিলল ম্যালেরিয়ার পরজীবী। অ্যানোফিলিস মশা, আজ সবাই যার সম্পর্কে জানি। পুরো জীবনচক্র উদ্ধার করলেন তিনি। এক ধাক্কায় ধরাশায়ী ম্যালেরিয়া। তারপর কুইনাইন প্রয়োগ তো আছেই। তিনি কিন্তু নোবেল পেয়েছিলেন। 'সাহেব' হওয়ায়?
আরও পড়ুন
গবেষণার জন্য পেতে পারতেন নোবেল, বিস্মৃতির অতলে ‘কেমোথেরাপির জনক’ ডঃ সুব্বারাও
ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও। তাঁর বেঙ্গল কেমিক্যালস থেকে তৈরি হতে লাগল হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনিন। ব্যস, তখন থেকে ম্যালেরিয়াও বশে চলে এল! দুটো রোগকে এভাবেই থামিয়ে দিয়েছিল বাংলা। ইতিহাস সাক্ষী সেসব দিনের…
তথ্যসূত্র -
১) ‘বারবার ব্যর্থতার পরে মিলেছিল সাফল্য’, অরুণাভ সেনগুপ্ত, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘ম্যালেরিয়ার রস-ঠিকুজি কলকাতারই দান’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী: মরণঘাতী কালাজ্বরের প্রতিষেধকের আবিষ্কারক’, অতনু চক্রবর্তী, রোর বাংলা
আরও পড়ুন
মনোনয়নের তালিকায় বাঙালি চিকিৎসকের নাম, আসতে চলেছে নোবেল?
Powered by Froala Editor