জর্জ বার্নাড শ তাঁর বিখ্যাত "দ্য ডক্টর'স ডিলেমা" নাটকে একটি আশ্চর্য উক্তি লিখেছিলেন। নাটকে স্যার ব্লুমফিল্ড বোনিংটন নামে এক চিকিৎসক তাঁর কাউন্সেলিং চেম্বারে বসে বলে উঠলেন- "ওষুধ কেবলমাত্র উপসর্গগুলোকে কমিয়ে দেয়, তা কখনো রোগ নির্মূল করতে পারে না। সমস্ত রোগের সত্যিকারের চিকিৎসা হল প্রাকৃতিক চিকিৎসা।" ১৯০৬ সালে লন্ডনের রয়্যাল কোর্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হওয়া এই নাটকের উক্তিটি একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ক্যানসার গবেষণার পাথেয় হয়ে থাকবে। কিন্তু কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের আরও একটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে, তা হল ‘ক্যানসার ইমিউনোথেরাপি’। কেমন যেন ধাঁধার মতো লাগছে, তাই না? তাহলে বিষয়টা খুলে বলা যাক।
ঘটনাটা শুরু হয় ১৮৯১ সালের এক সকালে। নিউ ইয়র্ক মেমোরিয়াল হসপিটালের বিখ্যাত চিকিৎসক ডঃ উইলিয়াম কোলে মেডিক্যাল রেকর্ডরুমে ফাইলের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। মন খুবই খারাপ। অনেক চেষ্টা করেও তিনি তাঁর রোগীকে বাঁচাতে পারেননি। 'বোনসারকোমা' বা অস্থির ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে ১৭ বছরের এক তরুণীর প্রাণ। ডঃ কোলে প্রাণপণে চেষ্টা করছিলেন হসপিটালের মেডিক্যাল রেকর্ড থেকে ক্যানসার রোগীদের সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করার। যে তথ্য তাঁকে এই জাতীয় ক্যানসার চিকিৎসায় সাহায্য করবে। হঠাৎই তাঁর চোখে পড়ে একটি রেকর্ড। কিছুদিন আগেই পূর্ব নিউ ইয়র্ক থেকে গলার পাশে বড়ো টিউমার নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল এক রোগী। পর পর দুবার অপারেশন করার পরেও টিউমার তৈরি হয়েছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। ঠিক একই রকম 'সারকোমা' প্রজাতির টিউমার। অপারেশন করার পরে বেড়ে চলেছে ক্ষত। ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। শুরু হয়েছে যন্ত্রণা আর প্রবল জ্বর।
চিকিৎসকরা তার বাঁচার আশা প্রায় যখন ছেড়ে দিয়েছেন, তখন ঘটল এক অদ্ভুত মিরাক্যাল! প্রবল জ্বর চলাকালীন ধীরে ধীরে তার টিউমার কমতে শুরু করল। সাড়ে চার মাস পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে রোগী বাড়ি ফিরে গেল। এই ঘটনা ডঃ কোলের মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি গবেষণা করে বার করার চেষ্টা করলেন শরীরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের সঙ্গে ক্যানসার কমে যাওয়ার সম্পর্কটা ঠিক কী। ডঃ কোলে পর্যবেক্ষণ করেন শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া নয়, ছত্রাক, ভাইরাস এবং আদ্যপ্রাণীর সংক্রমণেও অনেক ক্ষেত্রে টিউমার কমতে শুরু করে। অর্থাৎ সংক্রমণ শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটিকে এমন ভাবে বাড়িয়ে তোলে যাতে ক্যানসার পরাজিত হয়। ডঃ কোলে স্ট্রেপটোকক্কাস পায়োজেন্স এবং সেরাটিয়া মার্সিসেন্স নামে দুটি ব্যাকটেরিয়াকে গবেষণাগারে নিষ্ক্রিয় করে একজন ক্যানসার রোগীর শরীরে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রবেশ করালেন। এই চিকিৎসার পরে রোগীর তলপেট ও মূত্রথলির ক্যানসার সম্পূর্ণ সেরে যায়! সেই সময়ে ডঃ কোলের এই চিকিৎসা বিজ্ঞানীমহলে রীতিমতো সাড়া জাগায় এবং তার ওই ব্যাকটেরিয়া দুটির মিশ্রণকে "কোলে'স টক্সিনস" বলে উল্লেখ করা হয়। ডঃ উইলিয়াম কোলে পরিচিত হলেন ‘ক্যানসার ইমিউনোথেরাপির জনক’ হিসাবে। সেই সাথে ক্যানসার ভ্যাকসিন চিকিৎসার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল।
কিন্তু বিষয়টি সহজ ছিল না। কার্যকরী ক্যানসার ভ্যাকসিন পেতে মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় আরও দুই দশক! তার কারণ হিসাবে বলা যায়, প্রতিটি মানুষের অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি স্বতন্ত্র। কোনো ক্যানসার ভ্যাকসিন একটি মানুষের উপর প্রয়োগে সাফল্য পেলেও, একই ক্যানসারে আক্ৰান্ত পাশের মানুষটির ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হতে পারে। সাধারণ ভাবে ডঃ কোলে চেয়েছিলেন ক্যানসার আক্রান্ত মানুষের স্বাভাবিক ইমিউনিটিকে জীবাণুর মাধ্যমে জাগিয়ে তুলতে। বিশদে বলা যায়, মানুষের শরীরে কোনো স্থানের অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের ফলে তৈরি হয় টিউমার। সেই টিউমার কোষ যদি 'মেটাস্ট্যাটিক' পদ্ধতিতে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে নতুন টিউমার তৈরি করে, তখন দেখা দেয় ক্যানসার। আশ্চর্যের বিষয়, ম্যালিগন্যান্ট টিউমার শুধুমাত্র ক্যানসার কোষ দিয়ে তৈরি হয় না, তার সঙ্গে নিউট্রোফিল, ম্যাক্রোফাজ সহ অন্যান্য ইমিউন কোষগুলি একসাথে অবস্থান করে। একে টিউমার ‘মাইক্রোএনভায়রনমেন্ট’ বলে। শরীরের স্বাভাবিক ইমিউনিটির সাথে টিউমারের লড়াই চলে অবিরত, বেশিরভাগ সময়েই ইমিউনিটি দুর্বল হয়ে পড়ায় ক্যানসার জয়ী হয়। দূরদর্শী ডঃ কোলে সারাজীবন চেষ্টা করে গেছেন কীভাবে ক্যানসার রোগীর স্বাভাবিক ইমিউনিটিকে তথাকথিত ‘ক্যানসার ভ্যাকসিন’ দিয়ে বাড়িয়ে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাজে লাগানো যায়। বার্নাড শ'র নাটকের অনুষঙ্গের সঙ্গে যা হুবহু মিলে যায়!
আরও পড়ুন
আগামী পাঁচ বছরে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা, জানাল আইসিএমআর
কিন্তু এর পরে এক বড়ো সমস্যা দেখা দিল। নিষ্ক্রিয় জীবাণু বা তার প্রোটিনের সাহায্যে অনেকাংশে রোগসংক্রমণ আরও বেড়ে যায় এবং তাতে স্বাভাবিক ইমিউনিটি কিছু বাড়লেও ক্যানসার কোষকে তা সহজে চিনে ধ্বংস করতে পারে না। ফলে বেশিরভাগ ক্যানসার ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক গবেষণা তখন ব্যর্থ হতে শুরু করল। ব্যর্থতা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, জনৈক গবেষক বলেছিলেন – ‘ক্যানসার ভ্যাকসিনের ইতিহাস হল ব্যর্থতার ইতিহাস।’ সত্যিই, এক সময়ে প্রবাদ হয়ে উঠেছিল এই কথাটি। বিজ্ঞানীরা ইমিউন সিস্টেম আর ক্যানসারের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। এর ফলশ্রুতি হিসাবে জন্ম নিল একটি বিশেষ বিভাগ, যার নাম ‘টিউমার বায়োমার্কার রিসার্চ’। ক্যানসার কোষের মধ্যে বা কোষপর্দায় পাওয়া গেলো কিছু নির্দিষ্ট জৈব অণু যা স্বাভাবিক কোষে অনুপস্থিত। ওই জৈব অণুগুলিকে ক্যানসার বায়োমার্কার বলে। এগুলি ক্যানসার কোষকে চিনতে সাহায্য করে। আধুনিক যুগে, বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আমরা পেয়েছি প্রধানত পাঁচ প্রকার ক্যানসার ভ্যাকসিন।
১. অটোলোগাস ক্যানসার ভ্যাকসিন
ক্যানসার রোগীর শরীর থেকেই ক্যানসার বা ইমিউন কোষ সংগ্রহ করে, গবেষণাগারে কোষটিকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে পরিবর্তিত করে পুনরায় শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এই পরিবর্তিত কোষ ক্যানসার কোষ সমন্বিত টিউমারকে শনাক্ত করে ধ্বংস করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই পদ্ধতিকে ‘ব্যক্তিগত ক্যানসার চিকিৎসার’ পর্যায়ে ফেলা হয়। সিপুলিওসেল-টি নামে অটোলোগাস ক্যানসার ভ্যাকসিনের আবিষ্কার প্রস্টেট ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে।
আরও পড়ুন
ক্যানসারের আক্রমণের শিকার ছিল ডাইনোসরও! সাম্প্রতিক আবিষ্কারে চাঞ্চল্য
২. অ্যালোজেনিক ক্যানসার ভ্যাকসিন
বিভিন্ন ক্যানসার কোষকে কৃত্রিম ভাবে গবেষণাগারে কালচার করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়। এক্ষেত্রে রোগীর শরীর থেকে কোষ নেওয়া হয় না। মেলানোমা, লিউকেমিয়া, ফুসফুস ও অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার চিকিৎসায় অ্যালোজেনিক ক্যানসার ভ্যাকসিনের ব্যবহার আছে।
৩. ডিএনএ ক্যানসার ভ্যাকসিন
ক্যানসার বায়োমার্কার জিনকে ডিএনএ তে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ টেকনোলজির সাহায্যে ঢুকিয়ে তারপর রোগীর শরীরে ভ্যাকসিন হিসাবে প্রবেশ করানো হয়। ব্রেস্ট ক্যানসার, জরায়ু ক্যানসার চিকিৎসায় ডিএনএ ক্যানসার ভ্যাকসিন যথেষ্ট ভালো ফল করেছে।
আরও পড়ুন
ক্যানসারে আক্রান্ত রজনীকান্ত সেন, চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিক্রি করলেন গ্রন্থস্বত্ব
৪. প্রোটিন বা পেপটাইড ক্যানসার ভ্যাকসিন
ক্যানসার বায়োমার্কার প্রোটিন গবেষণাগারে পরিশুদ্ধ করে তার সঙ্গে ইমিউনিটি উদ্দীপক কোনো জৈব অণুকে যুক্ত করে ক্যানসার ভ্যাকসিন হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
৫. ডেনড্রাইটিক সেল ক্যানসার ভ্যাকসিন
ইমিউন কোষগুলির মধ্যে একটি বিশেষ কোষ হলো ডেনড্রাইটিক কোষ। এই কোষ শরীরে প্রবিষ্ট কোনো জীবাণুর অ্যান্টিজেনকে বিশেষ পদ্ধতিতে টি-লিম্ফোসাইটের কাছে উপস্থাপন করে। সঙ্গে নিঃসরণ করে বিভিন্ন সাইটোকাইন, ফলে ইমিউনিটি সক্রিয় হয়ে ওঠে ও জীবাণুকে ধ্বংস করে। বিজ্ঞানীরা ডেনড্রাইটিক কোষের এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে ক্যানসার কোষের কোনো অ্যান্টিজেন জিনকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্যে কোষের ডিএনএর ভিতরে প্রবিষ্ট করান। এর পরে, ওই পরিবর্তিত ডেনড্রাইটিক কোষগুলিকে ইমিউন উদ্দীপকের সঙ্গে ভ্যাকসিন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। রোগীর শরীরে টিউমারের মধ্যে নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনটি থাকায়, তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ইমিউন কোষ (এক্ষেত্রে টি-লিম্ফোসাইট) সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ক্যানসার কোষগুলিকে মেরে ফেলে। এই ডেনড্রাইটিক সেল ভ্যাকসিন ব্যবহারে অ্যাকিউট মায়েলয়েড সেল লিউকেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন
৩০ বছর কেটেছে নারী হিসেবেই, অবশেষে পুরুষজন্মের জানান দিল ক্যানসার!
আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসা ব্যবস্থায় ক্যানসার ভ্যাকসিন এখন একটি অপরিহার্য অঙ্গ। তবে, বিজ্ঞানীদের মতে এখনো বহু গবেষণার কাজ বাকি। ক্যানসারের চরিত্র পাল্টাচ্ছে, রোগ উপসর্গের পরিবর্তন হচ্ছে সঙ্গেবাড়ছে চিকিৎসার জটিলতা। শরীরের ইমিউনিটি সক্রিয় হলেও ক্যানসার কোষ নিজেকে এমন ভাবে পরিবর্তিত করে ফেলছে তাঁকে ইমিউন কোষগুলি সহজে চিনতে পারছে না। ক্যানসার কোষের এই ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিতে বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ক্যানসার ভ্যাকসিন গবেষণার মাধ্যমে। বহু ক্যানসার ভ্যাকসিনের হিউম্যান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। ক্যানসারকে পরাজিত করার সুদৃঢ় সংকল্পে তাই বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আজ সামিল সারা বিশ্ববাসী।
তথ্যসূত্রঃ
1. McCarthy EF. The toxins of William B. Coley and the treatment of bone and soft-tissue sarcomas. Iowa Orthop J. 2006;26:154-158.
2. Wiemann B, Starnes CO. Pharmacol Ther. 1994; 64(3):529-64.
3. Liu M, Guo F. Recent updates on cancer immunotherapy. Precis Clin Med. 2018;1(2):65-74. doi:10.1093/pcmedi/pby011
4. Justiz Vaillant AA, Nessel TA, Zito PM. Immunotherapy. [Updated 2020 Jun 22]. In: StatPearls [Internet]. Treasure Island (FL): StatPearls Publishing; 2020 Jan-. Available from: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK519046/
5. Zhang H, Chen J. Current status and future directions of cancer immunotherapy. J Cancer. 2018;9(10):1773-1781. Published 2018 Apr 19. doi:10.7150/jca.24577
6. Apostolopoulos V. Cancer Vaccines: Research and Applications. Cancers (Basel). 2019;11(8):1041. Published 2019 Jul 24. doi:10.3390/cancers11081041
7. Butterfield LH. Cancer vaccines. BMJ. 2015;350:h988. Published 2015 Apr 22. doi:10.1136/bmj.h988
8. Terbuch A, Lopez J. Next Generation Cancer Vaccines-Make It Personal!. Vaccines (Basel). 2018;6(3):52. Published 2018 Aug 9. doi:10.3390/vaccines6030052
9. Schlom J, Hodge JW, Palena C, et al. Therapeutic cancer vaccines. Adv Cancer Res. 2014;121:67-124. doi:10.1016/B978-0-12-800249-0.00002-0
Powered by Froala Editor