‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না।’ আক্ষেপের রং গাঢ় হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায়। দেখা হয়নি তিন প্রহরের বিল, লাঠি-লজেন্সের স্বাদ পাওয়া হয়নি জিভে। মানুষ—সে তো আসলে একা! ভিড়ের মধ্যে একা। রাতের ঘড়ির শব্দের মতো একা।
তবুও কারা যেন কথা রাখে। আজও। আটষট্টি বছর ধরে যাদের মধ্যে কথা হয়েছে শুধুমাত্র গুচ্ছ গুচ্ছ চিঠিতে, কোনোদিন আলাপ হয়নি মুখোমুখি। তাদেরই একজন কালবৈশাখীর মতো একদিন আচমকা উপস্থিত হয় দুয়ারে। আমেরিকার সাউথ ক্যারোলিনা আর ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কশায়ারের দুই পত্রবন্ধুর (Pen Pal) সাক্ষাৎ হয় জীবনসায়াহ্নে এসে।
আলাপ হয়েছিল চিঠিতে। তখন ১৯৫৫ সাল। ইংল্যান্ডের ‘গার্ল স্কাউট’-এর অনুষ্ঠানে প্যাটসি গ্রেগরি (Patsy Gregory) নামের বাচ্চা মেয়েটি কোনোভাবে পেয়ে যায় আমেরিকার এক সমবয়সীর ঠিকানা। আবেগের বশেই পাঠিয়ে দেয় চিঠি। তারপর কিছুদিনের উৎকণ্ঠা। সত্যিই কি আতলান্তিক মহাসাগরের ওপারে ক্যারল-অ্যান ক্রউস (Carol-Ann Krause) নামের একটি বারো বছর বয়সী মেয়ের অস্তিত্ব আছে? চিঠি পৌঁছবে তার ডাকবাক্সে? উত্তর দেবে সে?
তাকে হতাশ করেনি ক্যারল। কিছুদিনের মধ্যেই এসে পড়ে বিস্তারিত উত্তর। আর সঙ্গে অসংখ্য প্রশ্ন। ওখানের আবহাওয়া কীরকম, প্যাটসির বাড়িতে কারা আছে, কোন ক্লাসে পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। জমে ওঠে পত্রালাপ। চিঠির অক্ষরে দুটি কিশোরী মেয়ে চিনতে শেখে দুটি আলাদা দেশকে। স্কুল থেকে ফিরেই সারাদিনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে রোজ তারা চিঠি লেখে বন্ধুকে। যেন একছুটে পাশের বাড়ির সবুজ লনে খেলতে যাওয়া। সব চিঠি অবশ্য যথাস্থানে পৌঁছোয় না। তবু ভালোবাসা আসে জন্মদিনে, ক্রিসমাসে। খাতার শেষ পাতায় লেখা শব্দের দল পাড়ি দেয় হাজার-হাজার কিলোমিটার।
আরও পড়ুন
চিঠি লেখেন সত্যজিৎ
ক্যারল তখন পরিবারের সঙ্গে নিউ-ইয়র্কে। শহরের বর্ণনা শুনে তো প্যাটসি অবাক। এত লোকের ভিড়ে দমবন্ধ লাগে না? ক্যারল বুঝিয়ে দেয় মহানগরের ইতিবৃত্ত। আর জানতে চায় ইংল্যান্ডের শান্ত গ্রাম্য পরিবেশ সম্পর্কে। তার বাড়ির সামনে কি লেক আছে? গোধূলির আলো কেমন করে বেগুনি করে দেয় আকাশকে? চিঠিতেই চলে ইতিহাস-ভূগোলের ক্লাস। নেশার মতো লাগে দুজনের। বড়ো হওয়ার শত ব্যস্ততার মধ্যেও চাপা উত্তেজনার অভ্যাসটি ত্যাগ করতে চায়নি কেউই।
আরও পড়ুন
৪৩টি দেশে পত্রমিতালি, হারানো অভ্যাস ফেরাচ্ছেন কেরালার তরুণী
বয়স বাড়ে। দিন পালটায়, সময়ও পালটে যায়। অভিজ্ঞতা বদলে দেয় কথা বলার বিষয়, কথা বলার ঢং। ১৯৬৪-তে বিয়ে হয় প্যাটসির। পরের বছর ক্যারলের। আমন্ত্রণ ছিল, কিন্তু আসা হয়ে ওঠেনি কারোরই। সাক্ষাৎপর্বটি অধরা থেকে গেল এবারও। শুভেচ্ছা এল চিঠিতেই। ধীরে ধীরে কমতে থাকে চিঠির সংখ্যা। সংসারের ব্যস্ততায় পত্রবন্ধুর জন্য কমে যায় বরাদ্দ সময়। বছরে হয়তো তিন-চারটে চিঠি, তবুও টিকে গেছে সম্পর্কটি।
মেয়েবেলার চিঠিগুলি ঘাঁটতে ঘাঁটতে একদিন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন প্যাটসি। দু-পক্ষে প্রায় ৮০০ চিঠি আদানপ্রদান হয়েছে। কেটে গেছে আটষট্টি বছর, আজও দেখা হয়নি ক্যারলের সঙ্গে। জীবনের সন্ধ্যা ঘনাতে দীর্ঘতর হয়েছে বন্ধুত্বের ছায়া। আর বুঝি সুযোগ হবে না। মেয়ে স্টেফ-কে বলেও ফেলেন সে কথা।
এ বছর প্যাটসির ৮০ তম জন্মদিনে মেয়ে তাঁর জন্য হাজির করে চমক— ল্যাঙ্কশায়ার যাওয়ার টিকিট। সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে বহু কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে ক্যারলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। একটু চিন্তাতেই ছিল স্টেফ। সাক্ষাতের সময় ৮০ বছরের দুই বৃদ্ধার আবেগের প্রকাশ কীরকম হবে, কে জানে! আশ্চর্যের বিষয়, বেশ সাদামাটাভাবে মিটল পুরো ব্যাপারটি। যেন বহুদিনের চেনা। যেন গত সপ্তাহেও ঘুরতে এসেছিল এখানে! তারপর গল্পে মেতে উঠল দুই পত্রবন্ধু।
অবশেষে বিদায়ের পালা। সেই প্রসঙ্গের বর্ণনা বরং থাক। পৃথিবী থেকে ক্রমেই বিলীন হতে শুরু করেছে এই সব বন্ধুরা। উঠে গেছে চিঠি লেখার চলও। পত্রমিতালি শব্দটির অস্তিত্ব শুধু অভিধানের পাতায়। নতুন যুগের বন্ধুত্বের সংজ্ঞা লেখা হয় সমাজমাধ্যমের লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের সংখ্যায়। আর তখনই প্যাটসি-ক্যারলরা মনে করিয়ে দেন হাতের মুঠো গলে বেরিয়ে যাওয়া সম্পর্কদের আবার বেঁধে নেওয়ার কথা। যার জন্য পাড়ি দেওয়া যায় হাজার-হাজার কিলোমিটার। তারা কথা রাখে বলেই তো ভরসা রাখা যায়। মাথা হেলিয়ে দেওয়া যায় কারোর কাঁধে। ছোট্ট ঘরটুকুতে ওঠে নতুন রঙের গন্ধ। এইটুকু তো গণ্ডি, সামান্য কয়েকজন পরিচিত মানুষ, চাইলে আগলে রাখাই যায় হৃদয়ের অচিনপুরে।
Powered by Froala Editor