মৃত্যুর দুশো বছর পরেও কলেজের আলোচনায় উপস্থিত থাকেন জেরেমি বেন্থাম

২০১৩ সালের কথা। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (University College London) বাৎসরিক কর্মসমিতির আলোচনায় উপস্থিত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। স্যুট-প্যান্ট-টাইয়ের কেতাবি পোশাকে আগমন ঘটেছে প্রত্যেকের। শুধু একজনই তার মধ্যে আলাদা। মাথায় বড়ো আকারের হলদে টুপি, গায়ে কালো জোব্বা। যেন কেউ এই গুরুগম্ভীর পরিবেশে নেহাত মজা করার জন্য চলে এসেছেন উনিশ শতকের পোশাকে। সেই ‘অদ্ভুত’ পোশাকের ভদ্রলোকের নাম জেরেমি বেন্থাম (Jeremy Bentham)। বাকিরা কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই নিল পুরো বিষয়টিকে। যথাসময়ে শুরু হল মিটিং। সে বছর অবসর নেবেন কলেজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তা ম্যালকম গ্রান্ট। ফলে আলোচনার বিষয়বস্তু বেশি। সবাই মতামত দিচ্ছেন নিজের, শুধু একজনই নীরব। কিন্তু কেন?

কারণ একটাই। তাঁর মৃত্যু ঘটেছে ১৮৩২ সালে। অর্থাৎ আজ থেকে ১৯০ বছর আগে। লন্ডন কলেজের আলোচনাসভায় বসিয়ে রাখা হয়েছে তাঁর আদলে তৈরি পুতুলকে। না, পুতুল বলা বলা পুরোপুরি ঠিক হল না। ওয়াক্সের তৈরি মূর্তিটির ভিতরে রয়েছে জেরেমি সাহেবের সত্যিকারের কঙ্কাল। এবং এভাবেই তিনি হাজির থাকেন কলেজের ঠিক মধ্যস্থলে। মাঝেমধ্যে আসেন কর্মসমিতির মিটিংয়ে। কিন্তু ঘুরেফিরে আসে সেই প্রশ্নটি। কারণটা কী? তেমন গুরুতর কিছু নয় অবশ্য, সবটাই জেরেমি সাহেবের উদ্ভট মাথার খেলা। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, মৃত্যুর পর দেহ বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে কলেজে। 

সেই বিশেষ পদ্ধতিটি ছিল আসলে নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতির মতো। কাজও শুরু হয় সেই অনুযায়ী। কিন্তু কাঁচা হাতের কাজে ক্রমশ বিকৃত হতে থাকে সারা শরীর। বিকট আকার ধারণ করে মাথাটি। ফলে বাতিল করতে হয় সেই পরিকল্পনা। অবশেষে চিরাচরিত পোশাকে, তাঁর সেই বিখ্যাত চেয়ারে বসিয়ে তৈরি করা হয় একটি মূর্তি। নিজের বলতে থাকল শুধু কঙ্কালটি। মূর্তির নামও ঠিক করে গেছিলেন নিজেই। সেটিকে বলা উচিত ছিল ‘অটো আইকন’ (Auto Icon)। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাকে বর্তমানে ডাকা হয় ‘সেলফ ইমেজ’ (Self Image) বলে। এভাবেই প্রায় দুশো বছর ধরে বসে আছেন কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আর তার নিচে রাখা আছে সেই অদ্ভুতদর্শন মাথাটি।

আরো একটি ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। কলেজের আলোচনাসভায় অবশ্যই ডাকতে হবে তাঁকে এবং সেখানে তিনি নাকি ‘ভোট’-ও দেবেন। সেই অনুযায়ী ১৯২৬-এ কলেজের শততম বর্ষে, ১৯৭৬-এ দেড়শোতম এবং ২০১৩-তে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকেন তিনি। যদিও কোনোবারই হাত তুলে ‘ভোট’ দিতে পারেননি তিনি। 

আরও পড়ুন
ইংল্যান্ডের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার এবং ক্রমওয়েলের মুন্ডু

এর মধ্যে ঘটে যায় আরেকটি ঘটনা। গত শতকের শেষ দিকে আচমকা নিখোঁজ হয়ে যায় তাঁর মাথাটি। ফোন আসে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। ১০০ ডলারের পরিবর্তে ফেরত দেওয়া হবে মাথা, এই প্রস্তাব রাখে অপহরণকারীরা। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা রাজি হয় ১০ ডলারে। অবশ্য অর্থ দেওয়ার আগেই পরদিন মাঠে খুঁজে পাওয়া যায় মাথাটি। বোঝাই যায়, কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই জেগেছিল এই দুর্বুদ্ধি। কিন্তু তারপর আর ঝুঁকি নেয়নি কর্তৃপক্ষ। মাথাটি স্থানান্তরিত করা হয় সুরক্ষিত স্থানে। মূর্তিটিকেও ঢেকে দেওয়া হয় কাচের আবরণে। যিনি নিজে বিখ্যাত ছিলেন রসিকতার জন্য, মাথা ‘অপহরণ’-এ তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন কিনা বলা মুশকিল!

আরও পড়ুন
মুণ্ড শিকারের গ্রাম! ভারত-মায়ানমার দু’দেশেরই নাগরিক এই গ্রামের বাসিন্দারা

আসলে সারা জীবন জুড়েই তিনি অসংখ্য রসিকতার উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। আবার বিজ্ঞানচর্চা ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের কাজকর্মেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল তাঁর। আধুনিক উপযোগিতাবাদের মতো জটিল বিষয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় তাঁকে। আবার সামাজিক আন্দোলনে অগ্রদূতের ভূমিকা ছিল জেরেমির। চার্চের থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করার সপক্ষে বক্তব্য ছিল তাঁর। মহিলাদের সমানাধিকার, বিবাহবিচ্ছেদের স্বাধীনতা, এমনকি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়েও লড়েছিলেন তিনি। এসব কিছুর মধ্যেও শিশুসুলভ মজায় নিয়ে এসেছিলেন এক অদ্ভুত কারাগারের পরিকল্পনা। যার নাম ‘পানোপটিকন কারাগার’। এর বিশেষত্ব হল, অপরাধীরা ভাববে যে তাঁরা মুক্ত, কিন্তু আসলে সর্বক্ষণই নজর রাখা হবে তাদের। যদিও ১৯২০-তে কিউবার শাসক ছাড়া কেউই গুরুত্বসহকারে নেয়নি কারাগারের বুদ্ধিকে। ‘অবাস্তব’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। অবশ্য দুশো বছর পরে এসে রাষ্ট্রীয় নজরদারির ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে কারোর মনে হতেই পারে, সত্যিই কি ‘অবাস্তব’ ছিল এই পরিকল্পনা, নাকি এ বিষয়েও ভবিষ্যতদ্রষ্টা ছিলেন তিনি? 

Powered by Froala Editor