রেলগাড়ির সমস্ত কামরা মানুষে ঠাসা। শুধুই কামরা নয়, মালপত্র নিয়ে যাওয়ার লাগেজ ভ্যানের মধ্যেও ধরে ধরে তুলে দেওয়া হচ্ছে বহু মানুষকে। এঁরা সকলেই নেদারল্যান্ডস নিবাসী ইহুদি। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এই সময়েই রেলগাড়ির কাঁচের জানলা দিয়ে দেখা গেল দুজন শিশুর মুখ। একজন সবে বছরখানেকের। আর একজন একটু বড়ো। বছর তিনেক হবে। হলোকাস্টের শিকার বহু মানুষের মতো তাদেরও এতদিন ছবিই দেখেছে সবাই। প্রকৃত পরিচয় জানা ছিল না। তবে সম্প্রতি নেদারল্যান্ডের দুই সমাজবিজ্ঞান গবেষক খুঁজে পেয়েছেন দুই শিশুর পরিচয়। মঙ্গলবার কার্ট ব্রাসমা এবং গেরার্ড রসিং প্রকাশ করলেন তাঁদের নতুন গবেষণাগ্রন্থ ‘ক্যাম্প ওয়েস্টারবোর্ক গেফিল্মড’। আর সেখানেই এই দুই শিশুর পাশাপাশি আরও ১০ জন ব্যক্তির পরিচয়ের সন্ধান দিয়েছেন দুই লেখক। তাঁদের অনেকেই হলোকাস্টে প্রাণ হারাননি। কেউ কেউ এখনও বেঁচে আছেন।
রেলগাড়ির জানলা দিয়ে দেখা গিয়েছিল যে ছোট্ট শিশুদের, তাঁরাও বেঁচে আছেন দুজনেই। তবে এখন তাঁদের বয়স হয়েছে ঢের। ১ বছরের ছোট্ট শিশুটির বয়স এখন ৭৮ বছরে। তাঁর নাম স্টেলা ডেগেন। আর তাঁর পাশেই সেদিন ছিলেন তাঁর দাদা মার্ক ডেগেন। মার্কের বর্তমান বয়স ৮০। নাৎসি কনসন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা দুই ভাইবোনের সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথাও লিপিবদ্ধ করেছেন ব্রাসমা ও রসিং। পাশাপাশি যে ৮০ মিনিটের ঐতিহাসিক ভিডিও ফুটেজে তাঁদের দেখা গিয়েছিল, সেটির সূত্র ধরে তৈরি করেছেন একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রও। মঙ্গলবারই সেই তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হল ডাচ মিডিয়া আর্কাইভের সৌজন্যে।
‘ক্যাম্প ওয়েস্টারবোর্ক’ নামের এই ভিডিও ফুটেজটি অবশ্য এর আগেও বহু তথ্যচিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। ৮০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে ওয়েস্টারবোর্ক ট্রানজিট ক্যাম্পের বন্দিদের জীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৯ মে, ১৯৪৪ সালে ক্যামেরাবন্দি করা এই রেলগাড়ির দৃশ্যটি। আসলে এই ফুটেজের চিত্রগ্রাহক ওয়ার্নার রুডলফ ব্রেসলোরও ছিলেন ট্রানজিট ক্যাম্পের একজন বন্দি। তাঁকে নাৎসি কর্মাধ্যক্ষরাই নির্দেশ দিয়েছিলেন, ক্যাম্পের বন্দিদের নিয়মিত কায়িক পরিশ্রমের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার। উদ্দেশ্য ছিল, সেই ছবি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর। কারণ এই ট্রানজিট ক্যাম্পের বন্দিদের থেকে কারখানার যথেষ্ট সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে না বলে তখন অনেকেই ক্যাম্পটি তুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। এই ভিডিও ফুটেজ দেখে অধ্যক্ষরা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে কাজ বেশ ভালোভাবেই হচ্ছে।
ব্রেসলোর অবশ্য নির্দেশিত কাজের চেয়ে একটু বেশিই করেছিলেন। ১৯ মে হঠাৎ গোপনে রেলগাড়ির ছবি তুলতে শুরু করলেন। এর আগেও দুদিন তিনি এমনটা করেছিলেন। সেবার ট্রেনগুলি এসেছিল নেদারল্যান্ডসের নানা প্রান্ত থেকে নতুন বন্দি নিয়ে। আর এবার ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে বন্দিদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বার্জেন-বেলসেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য দেখলে সত্যিই শিহরিত হতে হয়। পরে এইসমস্ত দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার জন্য ধরাও পড়েছিলেন ব্রেসলোর। কোনোরকমে পালিয়ে গিয়েছিলেন নাৎসিদের হাত থেকে। দীর্ঘদিন লুকিয়ে লুকিয়ে থেকে কবে, কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয় তাও সঠিক জানা যায় না। শুধু যুদ্ধের শেষে থেকে যায় তাঁর এই ভিডিও ফুটেজটি। আর থেকে গিয়েছেন মার্ক ও স্টেলা ডেগেনের মতো বহু মানুষ, যাঁদের স্মৃতিতে এতদিন পরেও এক দগদগে ঘা হয়ে থেকে গিয়েছে হলোকাস্টের দিনগুলি।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরমে, ‘শত্রুপক্ষ’ আমেরিকার বুকে মার্চ করলেন হিটলার!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মেডেলজয়ী বাবা, জানতেন না সন্তানরাও!