কেউ প্রয়াত হয়েছেন। কেউ সত্তরের কোঠায়। কারোর আবার চাকরিতে ফেরার বয়স থাকলেও, শারীরিক অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়। মুম্বাই শহরকে ঝকঝকে রাখার দায়িত্ব সামলাতেন তাঁরাই। তবে দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে তাঁরা প্রায় সকলেই কর্মহীন। বলতে গেলে, তাঁদের রুজিরুটি, অন্নসংস্থানের পথটা বন্ধ করে দিয়েছে খোদ বৃহত্তর মুম্বাই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (BMC)। হ্যাঁ, খোদ বাণিজ্যনগরীতেই এমন অবিচারের শিকার অর্থনৈতিক পিরামিডের নিচের তলার মানুষরা।
শ্রমিক বনাম প্রশাসনের এই দ্বন্দ্বের শুরু নব্বইয়ের দশকে। যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন মুম্বাই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে সাফাইকর্মী (Sanitization Workers) নিয়োগের প্রক্রিয়া ছিল খানিকটা ভিন্ন। বিভিন্ন বেসরকারি ঠিকাদার সংস্থাই প্রাথমিকভাবে সাফাইকর্মীদের নিয়ে আসত কর্পোরেশনের কাজে। তাঁদের বেতনও হত কম। বছর তিনেক এইভাবে কাজ করার পর সরকারি কর্মী হিসাবে নিযুক্ত করা হত তাঁদেরকে।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই অলিখিতভাবে বদলে যায় এই নিয়ম। স্থায়ী কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয় মুম্বাই প্রশাসন। সাফাইকর্মীদের ইউনিয়ন থেকে একাধিকবার আবেদন করার পরও লাভ হয়নি খুব একটা। ১৯৯৯ সালে বাধ্য হয়ে আদলতের দ্বারস্থ হয় মুম্বাইয়ের কর্মী সংগঠনটি। মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। জয়ও আসে সেই মামলায়। ২০০৩ সালে ৫৮০ জন অস্থায়ী সাফাইকর্মীকে স্থায়ী চাকরি প্রদানের নির্দেশ দেয় ভারতের শীর্ষ আদালত।
তবে সে বিজয়ের হাসি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কেননা, শীর্ষ আদালতের আদেশ অমান্য করেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাইবুনালের পাল্টা মামলা করে মুম্বাই কর্পোরেশন। সেইসঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজও হারান মুম্বাইয়ের অস্থায়ী সাফাইকর্মীরা। ‘অস্থায়ী কর্মী’ থেকে তাঁরা হয়ে ওঠেন ‘স্বেচ্ছাসেবক’। কোনো ঠিকাদার সংস্থা নয়, ২০০৪ সাল থেকে তাঁদের বেতন দিত বিভিন্ন এনজিও। আগের তুলনায় অর্ধেকের কম বেতনে, কাজও করতে হত প্রায় দ্বিগুণ। প্রাথমিকভাবে ট্রাইবুনাল মামলা চলাকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট পাঁচ শতাধিক কর্মীকে অস্থায়ী কাজ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও, বছরের বেশিরভাগ সময়েই বাড়িতে বসে থাকতে হত তাঁদের।
এই অরাজকতার প্রতিবাদেই ২০০৬ সালের জুন মাসে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সামনে বিক্ষোভ অবস্থানে সামিল হন হাজারেরও শ্রমিক। ততদিনে অভিযোগের তালিকাও যে দীর্ঘ হয়েছে আরও। সেই অবস্থানের দ্বিতীয় দিনেই ঘটে যায় এক হিংসাত্মক ঘটনা। পুলিশের এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জ নেমে আসে কর্মীদের ওপরে। বেশ কিছু মানুষ ভয়াবহভাবে আহত হলেও তাঁদের কোনোরকম আর্থিক সহায়তা করেনি মুম্বাই প্রশাসন। বাকিদের নামে চার্জশিট দায়ের করে মুম্বাই পুলিশ। তারপর আদালতের বিচারে গ্রেপ্তার, সরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর শাস্তিস্বরূপ দীর্ঘদিনের কারাদণ্ড।
এই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে প্রায় দেড় দশক। কিন্তু আজও ট্রাইবুনালের খাতায় অমীমাংসিত শ্রমিকাধিকারের মামলা। প্রশ্ন থেকে যায়, খোদ প্রশাসনের এমন অমানবিক আচরণের কারণ কী? দেখতে গেলে, এর পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে অর্থনীতি। সরকারের অর্থকোষ বাঁচাতে স্থায়ী কর্মীদের পরিবর্তে তাই কম বেতনের স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের দিকেই ক্রমশ ঝুঁকছে প্রশাসন। সেইসঙ্গে ৯৯ শতাংশ সাফাইকর্মী দলিত সম্প্রদায়ের হওয়াও কি আরও একটি কারণ এই অবিচারের? বিগত আড়াই দশক ধরে প্রশাসনের এই পদক্ষেপে ধুঁকছে মুম্বাইয়ের প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি পরিবার। আজ সুবিচার পেলেও কর্মক্ষেত্রে ফেরার আর কোনো সুযোগ নেই তাঁদের। কে দেবে তাঁদের এই ক্ষতিপূরণ? তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎই বা কী? জানা নেই উত্তর…
Powered by Froala Editor