সময়টা ১৯৪৮ সাল। স্বাধীনতা এসেছে, সীমান্তরেখা বরাবর সদ্য ভাগ হয়েছে ভারত এবং পাকিস্তান। এর মধ্যেই কাশ্মীর উপত্যকায় মুখোমুখি দুই দেশের সেনাবাহিনী। যুদ্ধের ময়দানে লুটিয়ে পড়ছেন এক ভারতীয় সেনা। উলটোদিক থেকে ধেয়ে আসছে অটোমেটিক রাইফেলের গুলি। শুধুই কি গুলি? সঙ্গে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটিই যে চিয়ার-আপ করছেন বিপক্ষ দলের এই যোদ্ধাকে। বলছেন, তাঁর দাদা কখনও এত সহজে হেরে যেতে পারেন না। হ্যাঁ, সেদিন কাশ্মীর উপত্যকায় মুখোমুখি হয়েছিলেন দুই ভাই, ইউনুস খান এবং ইউসুফ খান। যাঁরা কখনও একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে। আবার তারপর দুজনের দেশ আলাদা হয়ে গিয়েছে। দুই ভাই অস্ত্র ধরেছেন একে অপরের বিপক্ষে।
রামগড়ের নবাব পরিবারের সন্তান সাহিবজাদা ইউনুস খান এবং ইয়াকুব খান। বিশ শতকের শুরুতেও ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম ক্ষমতাসম্পন্ন দেশীয় রাজ্যগুলির একটি ছিল রামগড়। কিন্তু দুই ভাইয়ের কেউই রাজ্যপাট সামলাতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। যুদ্ধের বিরোধী হয়েও দুজনেই চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। তখন ইউরোপে হিটলার এবং মুসোলিনির উত্থানকে ঘিরে চিন্তিত গোটা পৃথিবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দুই ভাই যোগ দিলেন রয়্যাল ইন্ডিয়ান আর্মিতে। পৌঁছে গেলেন সুদূর লিবিয়া বর্ডারের কাছে। সেখানেই ১৯৪২ সালে জার্মাআন ও ইতালির সৈনিকদের হাতে বন্দি হলেন ছোটভাই ইয়াকুব খান। মুক্তি পেলেন একেবারে যুদ্ধের শেষে।
ততদিনে অবশ্য স্বদেশজুড়ে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা তখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। স্বাধীনতা এল, কিন্তু ভারত অখণ্ড রইল না। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গেল দুই দেশে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বী পাকিস্তান। রামগড়ের নবাবের পরিবার কোনদিকে যাবেন? দুই ভাইয়ের মধ্যে তর্ক শুরু হল। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে কিছুতেই রাজি নন ইউনুস খান। অন্যদিকে ইয়াকুবের মনে হয়, মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র তৈরি হলে সেখানেই চলে যাওয়া উচিৎ। ইয়াকুব পাকিস্তানে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে দাদাকে বলে গেলেন, যুদ্ধ তো সেই একসঙ্গেই করবেন। আলাদা রাষ্ট্র হলেও ভারত আর পাকিস্তান যে একই দেশ।
কিন্তু সেই কথা রাখতে পারলেন না দুই ভাই। আসলে তাঁরা তো কেবল সৈনিক। যুদ্ধের প্রতিপক্ষ স্থির করার স্বাধীনতা তাঁদের নেই। তাই দেশভাগের মাত্র এক বছরের মধ্যেই কাশ্মীর উপত্যকায় দুই ভাইকে অস্ত্র তুলে নিতে হল পরস্পরের বিপক্ষে। ইয়াকুব নিজেই পর্যুদস্ত করেছিলেন ইউনুসকে। অথচ দাদার এমন শোচনীয় পরাজয়ও মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। এরপর ১৯৬৫ সালের যুদ্ধেও ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন ইয়াকুব। তবে ইউনুস খান ততদিনে অবসর নিয়েছেন। ফলে আর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি তাঁদের। কিন্তু দেশ মানে ছোটো থেকে হিন্দুস্তানকেই চিনতেন ইউনুস এবং ইয়াকুব দুজনেই। পাকিস্তানে থেকে, স্বধর্মের মানুষদের সঙ্গে থেকেও যেন ইয়াকুবের মন তাই কিছুতেই শান্তি পেত না। একাধিক চিঠিতে দাদাকে লিখেছেন সে-কথা। ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে তাই ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কাছে বিশেষ আবেদন জানালেন ইয়াকুব। তিনি নিজের পরিবারের কাছে ফিরতে চান। অনুমতিও পাওয়া গেল। আবার দুই ভাই একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। যুদ্ধের কিন্তু শেষ হল না। এই অর্ধেক ভারতকেও কি দেশ বলে মনে করতে পেরেছিলেন তাঁরা? ইতিহাস তার উত্তর দেয়নি...
তথ্যসূত্রঃ
১. Story of two Khans, Hamid Mir, Prothomalo.com
২. An officer and a gentleman, Sultan M Hali, Pakistantoday
Powered by Froala Editor