কথায় বলে, প্রয়োজনই আবিষ্কারের কারণ। আর আবিষ্কার বলতে তো শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নয়, শিল্পের জগতে নতুন নতুন ধারণার অবকাশও তো একধরণের আবিষ্কার। ঠিক যেমন এই লকডাউন পরিস্থিতিতে অনেকেই নানারকম সৃজনশীল কাজের নমুনা রাখছেন। আসলে একাকিত্বই যেন মানুষের অবসর বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এমন সৃজনশীল কাজের নমুনা পৃথিবীতে এই প্রথম নয়। এমনকি আঠেরো শতকে ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের গোড়াপত্তনের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে একধরনের শিল্পের ইতিহাস। এককথায় বললে তাকে বলতে হয় ‘পোট্রেট মিনিয়েচার’। অর্থাৎ ছোটো আকারের প্রতিকৃতি।
মনে রাখতে হবে, ক্যামেরার আবিষ্কার তখনও অনেক দেরি। ভিডিও কলে প্রিয়জনদের মুখোমুখি হওয়া তো কল্পনাই করা যায় না। এমনকি টেলিফোনও নেই। অতএব যোগাযোগের মাধ্যম বলতে কেবল চিঠি। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হয়ে যাঁরা ভারতে আসতেন, তাঁদের কাছে সেটা ছিল রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক। উঁচু পদের কর্মচারীরা অনেকেই পরিবার সঙ্গে নিয়ে আসতেন। কিন্তু যাঁদের সেই সামর্থ্য ছিল না? তাঁদের জন্যই শুরু হয় এই ‘পোট্রেট মিনিয়েচার’। ছোটো আকারের এইসব পোট্রেট অনায়াসে পাঠিয়ে দেওয়া যেত চিঠির সঙ্গে।
আকারে ছোটো হলেও এইসব পোট্রেটের মধ্যে সূক্ষ্মতার কোনো অভাব ছিল না। ঠিক ফোটগ্রাফের মতো না হলেও দেখে চেহারা বুঝতে অসুবিধা হয় না কোথাও। প্রথম প্রথম ইংল্যান্ড থেকে পরিবারের লোকজনই ব্রিটিশ কর্মচারীদের কাছে এইধরনের ছবি পাঠাতেন। ভারতে ব্রিটিশ পর্বের নানা সময়ের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে এমন অনেক ছবির সন্ধানই পাওয়া যায়। তবে এরপর এদেশ থেকেও পৌঁছে যেতে থাকে অনুরূপ ছবি। তবে তার কোনোটাই দেশীয় শিল্পীদের আঁকা নয়। কারণ এদেশের শিল্পকলায় মানব শরীরের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুকরণের রেওয়াজ ছিল না। এই উদ্দেশ্যেই ভারতে এসেছিলেন দুই শিল্পী। ডায়ানা হিল এবং জর্জ কার্টার।
১৭৮৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ আদালত জর্জ কার্টারকে ভারতে আসার অনুমতি দেয়। এর কিছুদিন পরেই অনুমতি পান ডায়ানা হিল। পরের বছরই বোম্বে হাইকোর্ট অনুমতি দেয়, ছবি আঁকার উদ্দেশ্যে এদেশের যেকোনো জায়গায় যেতে পারেন। চিত্রশিল্পের ইতিহাসে হয়তো এই নামদুটি এখনও তেমন আলোচিত নয়। কিন্তু ভারতের চিরায়ত শিল্পের ধারার সঙ্গে কি কোথাও গিয়ে একটা বিনিময় সম্পর্কে যাওয়ার কথা ভাবেননি দুই শিল্পী? সেকথা জানতে গেলে অবশ্য আরও দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন। শিল্পের ইতিহাসের অনেকটাই হয়তো লুকিয়ে আছে সেই একাকিত্বময় সময়ে।
Powered by Froala Editor