তাঁদের বেড়ে ওঠা ক্যালিফোর্নিয়ার অরণ্যে ঢাকা এক অঞ্চলে। সমুদ্র বেশি দূরে নয় সেখান থেকে। তাঁদের পরিবার সাতের দশকে ইরান থেকে চলে এসেছিল আমেরিকায়। মা-বাবার কাছে দুই যমজ বোন শুনত দেশের গল্প। ফুল আর প্রজাপতির সঙ্গে খেলা করতে করতে খুঁজতে চাইত না-দেখা মাতৃভূমিকে। সেভাবেই ভালোবাসা জন্মায় গাছেদের প্রতি। নির্বিচারে অরণ্যহত্যা কষ্ট দিত তাঁদের। কোনো উপায় কি নেই? ‘উন্নয়ন’-এর জন্য কি প্রকৃতিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া এত দরকারি? সেই প্রশ্নগুলির উত্তর তাঁরা খুঁজে পেলেন সম্প্রতি। তাঁরা আবিষ্কার করেছেন এমন এক পদ্ধতি, যার সাহায্যে জামাকাপড় তৈরি করা হবে কার্বন-ডাই অক্সাইড (Carbon Dioxide) দিয়ে।
দুই বোনের নাম লেইলা (Leila Mashouf) ও নিকা মাশুফ (Neeka Mashouf)। মাত্র পনেরো বছর বয়সে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় হাতেখড়ি তাঁদের। একই সময়ে পারিবারিক জামাকাপড়ের ব্র্যান্ড ‘বেবে স্টোর’-এর সৌজন্যে হাতেকলমে শিখেছেন পোশাক তৈরির যাবতীয় খুঁটিনাটি। একটা সময় পর্যন্ত এই নিয়ে মুগ্ধতা থাকলেও, ক্রমে বুঝতে পারেন পরিবেশের উপর তার প্রভাব। টেক্সটাইল ইন্ড্রাস্ট্রি থেকে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, তা বিশ্বের বায়ুদূষণের পক্ষে যথেষ্ট। সামগ্রিক পরিবেশকেও বিভিন্নভাবে ক্ষতি করে এই ইন্ড্রাস্ট্রি থেকে নির্গত বর্জ্য। যা রীতিমতো উদ্বিগ্ন করেছিল দুই বোনকে। তাঁদের কাছে একদিকে ছিল বিজ্ঞানের জ্ঞান, অন্যদিকে বস্ত্রশিল্প সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা। আর তাই ২০২১ সালে দুজনে মিলে আমেরিকায় তৈরি করেন ‘রুবি ল্যাব’ (Rubi Lab) নামের একটি স্টার্ট-আপ সংস্থা।
কার্বন নিঃসরণ এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ধারাবাহিক বিশ্ব উষ্ণায়নের হাত থেকে বাঁচার উপায় খুঁজে চলেছে মানুষ। নিকা আর লেইলার গবেষণা সেখানে রাখতে চলেছে এক যুগান্তকারী ভূমিকা। কীভাবে? তাঁরা আবিষ্কার করেছেন এক বিশেষ ধরণের উৎসেচক (Enzymes)। পরিবেশ থেকে দূষিত কার্বন ডাই অক্সাইডকে বন্দি করে এই উৎসেচককে অনুঘটকের মতো ব্যবহার করে পরিণত করা হবে সেলুলোজ (Cellulose) জাতীয় পদার্থে। সাধারণত তুলো, গাছের ছাল, পাতায় যা সহজলভ্য পদার্থ। পরবর্তী ধাপে সেলুলোজ দিয়ে তাঁরা তৈরি করেছেন ‘ভিসকোস’ (Viscose) তন্তু। যা কোনো প্রাকৃতিক তন্তু নয়, রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণের নির্মাণ করা হয় ভিসকোস। বস্ত্রশিল্পে কৃত্রিম রেয়ন নামেও পরিচিতি আছে তার। অনেক বিখ্যাত ব্র্যান্ডের পোশাকেও ব্যবহার করা হয় এই তন্তু। অন্যান্য ক্ষেত্রে ভিসকোস তৈরিতে প্রয়োজন পড়ে গাছের শাঁসের, যে কারণে প্রতিবছর কাটা পড়ে অসংখ্য গাছ। কিন্তু ‘রুবি ল্যাব’ পুরো প্রক্রিয়াটাতে ব্যবহার করছে কার্বন ডাই অক্সাইড।
দুই বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, তাঁদের কাপড় সম্পূর্ণ জৈবভাবে পচনশীল। সাধারণ ভিসকোস জাতীয় কাপড়ের থেকে খরচও অনেক কম। ইতিমধ্যেই ‘রুবি ল্যাব’-এর গবেষণার জন্য অনুদান দিতে শুরু করেছে আমেরিকা সরকার। আপাতত তাঁদের আবিষ্কার বস্ত্রশিল্পে সীমাবদ্ধ থাকলেও, ভবিষ্যতে খাদ্য, প্যাকেজিং-সহ অন্যান্য শিল্পের দিকেও হাত বাড়িয়ে দেবেন তাঁরা। ফলে এখন অপেক্ষা তাঁদের আগামী সাফল্যের। যা বিশ্বব্যাপী দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে দেবে মানবসভ্যতাকে।
আরও পড়ুন
উদ্ভট আবিষ্কারের জন্য পাওয়া যায় ‘নোবেল’, জোগাবে চিন্তার রসদও
চিত্রঋণ : রুবি ল্যাব
আরও পড়ুন
বিজ্ঞানীদের উদ্যোগে ফিরতে চলেছে হারিয়ে যাওয়া ‘রাজকীয়’ মাছ
Powered by Froala Editor