সাম্প্রতিক আমফানের প্রসঙ্গ ধরে বারবার উঠে এসেছে বিগত বিভিন্ন সাইক্লোনের ইতিহাস। ১৮৬৪-র সাইক্লোনের পরে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এপার বাংলায় আর আসেনি – মনে করছেন ইতিহাসবিদদের একাংশও। আমফানের ক্ষতি সম্পর্কে এখনও সম্পূর্ণ অবহিত নই আমরা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বহু অঞ্চলে। কিন্তু ১৫৬ বছর আগেকার সেই সাইক্লোনটি কেমন ছিল? তার ধ্বংসের স্বরূপই বা ছিল কেমন?
সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখছেন – ‘গঙ্গাধরপুরে যাইবার সময় পথে দেখিলাম, বহুসংখ্যক শবদেহ খালে, বিলে, ধান্যক্ষেত্রে ভাসিতেছে, এবং পথের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মধ্যে ও বনে জঙ্গলে, বৃক্ষোপরি ও ভূমিতলে ইতস্ততঃ পড়িয়া রহিয়াছে, এবং চতুর্দিকে মড়কের দুর্গন্ধ বিস্তার করিতেছে।’
শুধু তাই নয়, সুরেশচন্দ্র জানিয়েছেন, তাঁরা যখন ত্রাণ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, দু-তিনশো অভুক্ত ও পীড়িত মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন সেই ত্রাণ লুঠ করতে। ঘূর্ণিঝড়ের পর এমনই খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল বাংলায়। এই প্রসঙ্গে, সাম্প্রতিককালের কোনো দৃশ্য মনে পড়ছে কি? লকডাউনের ফলে অভুক্ত মানুষের খাবার লুঠের ছবি?
যাইহোক, সেবার শেষ পর্যন্ত খাবার লুঠ হয়নি। বণ্টন করা গিয়েছিল ঠিকমতোই। কী কী ছিল সেই ত্রাণসামগ্রীতে? চাল, ডাল, চিঁড়ে, নুন, সর্ষের তেল ও থানকাপড়। সুরেশচন্দ্র তখন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মজিলপুরের বাসিন্দা। তাঁকে ত্রাণ বিলি করতে গঙ্গাধরপুরে পাঠিয়েছিলেন কে জানেন? সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বঙ্কিম তখন বারুইপুর মহকুমার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর উপস্থিতিতেই, ১৮৬৪ সালের ৫ অক্টোবর সেই ভয়ঙ্কর সাইক্লোন। চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ডহারবার, কুল্লী, মুড়াগাছা, করঞ্জলি, গঙ্গাধরপুর, বাইশহাটা, মণিরটাট ইত্যাদি গ্রাম বিপর্যস্ত। সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস গিলেছে উপকূলের অনেক ভূমি। অজস্র লোক মৃত। পুরনো নথিপত্র বলছে, সেই সাইক্লোনে বাংলায় মারা গিয়েছিলেন ৬০,০০০ মানুষ।
যাইহোক, ক্ষয়ক্ষতির পর, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তৈরি হল ফান্ডও। পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষজন, বাংলার কয়েকজন জমিদার ও ইংরেজ সরকারি কর্মচারীরা মিলে একটি রিলিফ ফান্ড তৈরি করলেন। সাহায্য নিয়ে যাওয়া হল বিভিন্ন জায়গায়। অনাহারক্লিষ্ট ভিটেহারা মানুষ খেতে পেলেন। পেলেনও না অনেকেই।
এরপর, দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে, বারুইপুর ছেড়ে কিছুদিনের জন্য ডায়মন্ডহারবার মহকুমার ভার নিলেন বঙ্কিম। পরে অবশ্য ফিরে এসেছিলেন বারুইপুরেই।
ইতিহাস ঘেঁটে তুলে আনা এসব তথ্য অবশ্য ভয়ঙ্করতার ছবিও ফোটাতে পারে না ঠিকমতো। নিজের চোখে দেখা আর পড়ার মধ্যে অনেক ফারাক। আমরা দেখছি, আমফানের সূত্রে। পরিণতির যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, এটুকুই চাওয়ার আপাতত…
ঋণ – বঙ্কিম-প্রসঙ্গ / সুরেশচন্দ্র সমাজপতি
ছবি - জন আর্থার আর্মস্ট্রং
ঋণ - ব্রিটিশ লাইব্রেরি
Powered by Froala Editor