এই সুড়ঙ্গই পৌঁছে দেবে ক্লিওপেট্রার সমাধিতে?

স্বর্ণপালঙ্কে শুয়ে রয়েছেন রানি। আর নতজানু হয়ে তাঁর দিকে ফলের ঝুড়ি এগিয়ে দিচ্ছেন তাঁরই এক দাসী। তবে ফল নয়, এই ঝুড়িতেই লুকিয়ে রয়েছে বিষধর গোখরো। সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রা। মিশরের টলেমীয় সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সক্রিয় শাসক তিনি। আলেকজান্দ্রিয়াকে স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে, রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রেম— ক্লিওপেট্রার জীবন কম নাটকীয় নয়। তবে তার চেয়েও রহস্যময় তাঁর মৃত্যু। প্রেমিক মার্ক অ্যান্টোনিও-র মৃত্যুর পর নাকি নিজেই সর্পদংশনের মধ্যে দিয়ে নিজের প্রাণ নেন মিশরের সম্রাজ্ঞী। তবে এই কথিত গল্পের সত্যতা আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে যাচাই করতে পারেননি কেউ-ই। খোঁজ মেলেনি তাঁর সমাধিরও। এবার এই জটিল ধাঁধাঁর জট ছাড়তে চলেছে বলেই দাবি একদল ইজিপ্টোলজিস্টের। 

সান্টো ডোমিঙ্গো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক ক্যাথলিন মার্টিনেজ এবং তাঁর সহকর্মীরা বিগত ২০ বছর ধরে সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন ক্লিওপেট্রার (Queen Cleopatra) হারিয়ে যাওয়া সমাধির (Tomb)। এবার ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে তাঁরা সন্ধান পেলেন আশ্চর্য এক সুড়ঙ্গের। গবেষকদের ভাষায় যা নাকি এক ‘অলৌকিক জ্যামিতিক নকশা’। ৪২৮১ ফুট অর্থাৎ প্রায় দেড় কিমি দীর্ঘ এই সুড়ঙ্গের শেষেই শায়িত রয়েছেন রানি ক্লিওপেট্রা এবং তাঁর ভালোবাসা অ্যান্টোনিও। এমনটাই অভিমত মার্টিনেজ এবং তাঁর সহকর্মীদের। কিন্তু কোথায় অবস্থিত এই সুড়ঙ্গ?

যে-শহরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ক্লিওপেট্রার কিংবদন্তি, যেখানে একসময় তৈরি হয়েছিল প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থাগার, সেই আলেকজান্দ্রিয়াতেই লুকিয়ে রয়েছেন ক্লিওপেট্রা। শুধু গ্রন্থাগারের শহরই না, আলেকজান্দ্রিয়া ছিল প্রাচীন মিশরের মন্দিরের শহরও। গোটা শহর জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গড়ে উঠেছিল একাধিক আইসিস ও ওসাইরিসের মন্দির। ‘তাপোসিরিস ম্যাগনা’-খ্যাত তেমনই একটি মন্দিরের নিচেই সন্ধান মিলেছে এই সুড়ঙ্গের। ভূপৃষ্ঠের ৪৩ ফুট গভীরে অবস্থিত এই সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে নাকি রয়েছে ক্লিওপেট্রা-অ্যান্টোনিওর সমাধি, বিশ্বাস প্রত্নতাত্ত্বিকদের। 

তবে আজ না, ২০০৪ সাল থেকে এই অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন মার্টিনেজ। আর মজার বিষয় হল, এই ধাঁধাঁর প্রথম সূত্র ছিল খোদ রানি ক্লিওপেট্রার নাম। ক্লিওপেট্রাকে প্রাচীন মিশরীয়রা বাস্তব দুনিয়ার ‘দেবী আইসিস’ বলেই মনে করতেন। অন্যদিকে তাঁর প্রেমিক অ্যান্টোনিও-কে ধরে নেওয়া হত ওসাইরিস হিসাবে। এমনকি কিছু নথি এও জানায়, ক্লিওপেট্রা চেয়েছিলেন অ্যান্টোনিওকে সমাধিস্থ করা হোক আইসিসের মন্দিরেই। এই সূত্র ধরেই কাজ শুরু করেন মার্টিনেজ। বেছে নিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া শহরকে। সবমিলিয়ে প্রায় ৯টি আইসিস ও ওসাইরিসের মন্দির চিহ্নিত করে, অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল সেখানে। শেষ পর্যন্ত সাফল্য মেলে ‘তাপোসিরিস ম্যাগনা’ মন্দিরের খননের সময়। মন্দিরের মূল কাঠামোর নিচেই পাওয়া যায় এই আশ্চর্য সুড়ঙ্গটি। 

ইতিমধ্যেই এই সুড়ঙ্গের মধ্যে সন্ধান মিলেছে দেড় হাজারেরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর। যার মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু সোনার টুকরো, কয়েকটি ক্ষয়ে যাওয়া আবক্ষ মূর্তি, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, ক্লিওপেট্রা এবং টলেমি সম্রাটদের চিত্রিত মুদ্রা। তাছাড়া মন্দিরের নিকটেই প্রাচীন একটি শুকিয়ে যাওয়া হ্রদেরও সন্ধান পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। সবমিলিয়ে, পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, এই সুড়ঙ্গের শেষেই লুকিয়ে রহস্যের চাবিকাঠি। 

তবে এই সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে পৌঁছানো খুব একটা সহজ কাজ নয় বলেই জানাচ্ছেন ঐতিহাসিকরা। তার কারণ, ভূমধ্যসাগরের জলস্তর বৃদ্ধি। ভূমধ্যসাগর এগিয়ে আসার কারণে, সুড়ঙ্গের একাংশ ডুবে গেছে জলের তলায়। পাশাপাশি ভূমিকম্পের জেরেও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুড়ঙ্গটি। কাজেই দীর্ঘ এই পথ নতুন করে যাতায়াতযোগ্য করে তোলাই এখন বড়ো চ্যালেঞ্জ প্রত্নতাত্ত্বিকদের সামনে। তবে এই বাধা টপকে যেতে পারলে, একুশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাক্ষী হওয়া যাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা… 

Powered by Froala Editor