গভীর অরণ্যে ঘেরা একটি দ্বীপ। পাহাড়ের পাদদেশে বড়ো বড়ো গাছেদের ছায়া। একদম পাশেই সাতুর হ্রদ। এমনিতে ইন্দোনেশিয়ার (Indonesia) বালিতে (Bali) সারা বছর পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকলেও এই অঞ্চল খানিক নির্জনই বলা যায়। আগা জনজাতির (Aga People) মানুষদের কয়েকশো বছরের বাসস্থান এখানে। ঐতিহাসিক ও নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে বালির অন্য জনজাতিদের থেকে তাদের বিস্তর তফাৎ। তবে সবচেয়ে বড়ো পার্থক্য মৃতদেহ সমাধিস্থ করার পদ্ধতিতে। মৃতদের দাহ করা হয় না এখানে, করা হয় না কবরস্থও। বরং ফেলে রাখা হয় জঙ্গলের এক কোণে। হ্যাঁ, এভাবেই মৃতদেহ সৎকার করে ট্রুনিয়ান (Trunyan) গ্রামের আগা জনজাতির লোকেরা।
মৃত ব্যক্তিদের এইভাবে ‘ফেলে’ আসার প্রথা যদিও বিশ্বের বহু প্রান্তেই আছে। জরাথ্রুস্ট্রের মতবাদে বিশ্বাসী পারসিকরা দেহ পাহাড়ে রেখে আসে শকুনের খাদ্য হিসেবে। তিব্বতের এক শ্রেণির বৌদ্ধদের মধ্যেও আছে এই প্রথা। তবে ট্রুনিয়ান গ্রামের রীতিনীতি তাদের চেয়ে বিভিন্নভাবে আলাদা। জঙ্গলে ফেলে এলেও কোনো বন্য পশুপাখির দাঁত-নখে আত্মীয়দের শেষ পরিণতি দেখতে চায় না তারা। বরং নানা পদ্ধতিতে রক্ষা করে মৃত ব্যক্তিদের। কাপড়ে বাঁধা দেহগুলির চারদিকে তৈরি করে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে একটি খাঁচা। এভাবেই কেটে যায় দিনের পর দিন। ক্রমে পচন ধরতে ধরতে মাটিতে মিশে যায় দেহাবশেষ। পড়ে থাকে শুধু কঙ্কাল। ততদিন পালা করে পাহারা দেওয়া হয় তাদের। এরপর ওই হাড়গুলিকে রেখে আসা হয় কাছের এক পাহাড়ের পাদদেশে। নেহাৎ অযত্নে নয়, বরং পাহাড়ের ঢাল বেয়ে করোটিগুলি রাখা হয় পাশাপাশি। আর বাকি হাড়গুলিকে সাজিয়ে রাখা হয় তার পাশে। এভাবেই চলে তাদের সৎকারগাথা।
কিন্তু কেন এই ব্যবস্থা? এর সঙ্গে জড়িয়ে হিন্দু পুরাণের কাহিনি। প্রচলিত মত অনুযায়ী সাতুর পাহাড়ে লুকিয়ে আছে এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। যার বিস্ফোরণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়নি আজও। আগা জনজাতির মানুষরা বিশ্বাস করে যে, স্বয়ং ব্রহ্মার অধিষ্ঠান এখানে। তাঁকে সন্তুষ্ট রাখতে এগারোটি ছোটো মন্দিরও স্থাপন করা হয়েছে পাহাড়ে। আর তার সামনেই এগারোটি খাঁচায় রাখা হয় প্রিয় মানুষদের দেহ। সেগুলি পূর্ণ হয়ে নতুন খাঁচার দরকার পড়লে কঙ্কাল রেখে আসা হয় পাহাড়ের পাদদেশে।
তবে সবার জন্য বরাদ্দ নয় সৎকারের এই পদ্ধতি। বিবাহের মাধ্যমে যাদের জীবন পূর্ণতা পেয়েছে, তারাই শুধু এই সৎকারের দাবিদার। তবে মৃত্যু হতে হবে স্বাভাবিক, দুর্ঘটনায় বা আত্মহত্যার কারণে মৃতদের জন্য আছে পৃথক ব্যবস্থা। স্বাভাবিকভাবেই শিশুরাও বাদ এখান থেকে। ট্রুনিয়ানে গ্রামে এরকম বেশ কয়েকটি সমাধিস্থান থাকলেও পর্যটকদের প্রবেশাধিকার আছে শুধু একটিতেই।
আরও পড়ুন
এক জীবনে দু-বার সমাধিস্থ হতে হয়েছিল এই মহিলাকে!
তবে আশ্চর্যের বিষয়, এখনও পর্যন্ত কেউই সেখানে গিয়ে কোনো দুর্গন্ধ অনুভব করেনি। বরং একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধ সর্বক্ষণ ছড়িয়ে থাকে বাতাসে। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। মুক্ত বাতাসে ফেলে রাখা এগারোটি পচাগলা মৃতদেহ তো সুগন্ধ ছড়াতে পারে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে গ্রামবাসীরা আঙুল তুলে দেখিয়ে দেবে একটি বট গাছকে। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘মেন্যান ট্রি’। যার অর্থ সুগন্ধি গাছ। প্রচলিত যে, এক আশ্চর্য জাদুবলে এই গাছ থেকে নির্গত হয় মিষ্টি গন্ধ। অনেকেই বিশ্বাস করে এই গল্পে, অবিশ্বাসীর সংখ্যাও কম নয়। মৃতদেহের হাড়গোড় পাহাড়ে পাঠানোর আগে ব্যবস্থা করা হয় কিছু উপাচারের। তার জন্য অর্থের প্রয়োজন পড়ে। দরিদ্র গ্রামবাসীদের পক্ষে তাই অনেক সময়ই দেরি হয়ে যায় নিয়মনীতি পালন করতে। ততদিন প্রাকৃতিকভাবে তৈরি কোনো পদার্থের ব্যবহার করা হয় মৃতদেহের উপরে। অনেকে মনে করেন, দুর্গন্ধ না থাকার সবচেয়ে বড়ো কারণ এটাই।
আরও পড়ুন
পর পর সাজানো একের পর এক ঘোড়ার কঙ্কাল, কোথায় রয়েছে এই সমাধি?
শোক বিষয়টিকেও অদ্ভুতভাবে জয় করেছে তারা। বাড়িতে ফিরে উজাড় করে দিতে পারো দুঃখ, কিন্তু সমাধিস্থানে নিষিদ্ধ চোখের জল ফেলা। এটাই তাদের সংস্কৃতি, তাদের বিশ্বাস। তারা কষ্ট দিতে চায় না মৃত আত্মীয়দের। বিশ্বের প্রচলিত সৎকারপদ্ধতি থেকে যেমন পৃথক তাদের সংস্কৃতি, ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গিও তেমন তাদের নিজস্ব।
Powered by Froala Editor