মাঠে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু শিশু। আর তাদের হাতে ধরে থাকা গ্লাসে দুধ ঢেলে দিচ্ছেন কিছু যুবক-যুবতী। ত্রিপুরার বিশালগড়ে আজ সকালের ছবিটা ছিল এমনই। শিবরাত্রি আজ। আর ‘জীবজ্ঞানে শিবসেবা’-র মাধ্যমেই এই তিথি উদযাপন করলেন ত্রিপুরার তরুণ-তরুণীরা।
শিবরাত্রি মানেই সারাদিন উপবাসের পর শিবলিঙ্গের মাথায় দুধ ঢালার রীতি। বাংলা কেন সারা ভারতেই প্রচলিত এই রেওয়াজ। শুধু দুধই নয় সমানভাবে অর্ঘ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় ঘি, দই-ও। তবে পারতপক্ষে তা নষ্টই হয়। গোটা দেশ জুড়ে অপচয় হয় কয়েক হাজার কিংবা লক্ষ লিটার দুধ। অথচ ভারতের দারিদ্র সীমার নিচে রয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। পুষ্টির অভাবের মধ্যে বড়ো হচ্ছে হাজার হাজার শিশু। তাদের মুখে কি তুলে দেওয়া যায় না এই দুধ?
ঠিক এই চিন্তা-ভাবনাই দানা বেঁধে বসেছিল ত্রিপুরার অনুপম সাহা, সুস্মিতা রায়, প্রসূন দাস, ইন্দ্রজিৎ-দের মাথায়। সকলেই কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। আর তারপরই সিদ্ধান্ত এই ‘অন্য’ শিবরাত্রি পালনের। কবে থেকে শুরু হল এই উদ্যোগ? অন্যতম উদ্যোক্তা অনুপম সাহা জানালেন, “চার বছর আগে ২০১৭ সালে প্রথম এই চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। নিজেরা অন্য অন্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকলেও, এই উদ্যোগ ছিল সম্পূর্ণ নিজেদের”। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবেই প্রতিবছর ‘শিবসেবা’-র কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। চলতি বছরেও অন্যথা হল না তার।
আরও পড়ুন
সৌরজগতের মতোই নক্ষত্র ও গ্রহসমাবেশ; ২০০ আলোকবর্ষ দূরের সন্ধান দিল পড়ুয়ারা
“বিশালগড় রেলস্টেশনের কাছেই বেশ কিছু পরিযায়ী শ্রমিক থাকছেন। তাঁদের শিশুদের দুধ-বিস্কুট বিতরণ করেই উদযাপনের শুরু হয়েছিল আজ। তারপর স্থানীয় বেশ কিছু বাজারে মানসিক ভারসাম্যহীন, গৃহহীন ব্যক্তি, চা-বাগানের কর্মী-পরিবারের শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং পথশিশুদের দুধ দেওয়া হয়”, বলছিলেন আরেক উদ্যোক্তা সুস্মিতা রায়।
আরও পড়ুন
গার্হস্থ্য হিংসায় বন্দি মহিলাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেবে কলেজ পড়ুয়ারাই!
উদ্যোক্তাদের সকলেই যে কলেজ-পড়ুয়া, তা বলা হয়েছে আগেই। হাত খরচ চালাতে কেউ বা টিউশনও পড়ান। আর সামান্য উপার্জন বাঁচিয়েই এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তাঁরা। বলতে আপত্তি নেই ক্ষমতা সীমিত। তবে অনেকটা বড়ো স্বপ্নের আকাশ। আর তার জন্যই হয়তো তাঁদের একদিনের এই ছোট্ট উদ্যোগে উপকৃত হলেন ৫০-৬০ জন মানুষ। তরুণ-তরুণীদের এই কর্মকাণ্ড দেখে এগিয়ে এসেছে অনেকেই। যোগাযোগ করে জানতে চাইছেন ঠিক কীভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন তাঁরা। বৃহত্তর অর্থে সেটাই আরও বড়ো সাফল্য হয়তো। অনুপমবাবুর কথায়, “শিশুদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলাই পরম প্রাপ্তি আমাদের। আর এই প্রয়াস দেখে যদি আরও কিছু মানুষ এগিয়ে আসেন, তবে আমাদের ভারত ভালো থাকবে। হাসি থাকবে সকলের মুখে”।
তবে নেতিবাচক মন্তব্যেরও শিকার হতে হয়েছে তাঁদের। সেই জায়গাটা পরিষ্কার করে দিলেন উদ্যোক্তারা নিজেরাই। না, কোনো ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত নয়, বরং রামকৃষ্ণ কিংবা বিবেকানন্দের দেখান পথেই হাঁটছেন তাঁরা। ‘জীবে সেবা করে যেই জন/ সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’— একথাই যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তরুণদের অভিনব উদ্যোগ। একদিন তা বৃহত্তর পরিসরে জনসচেতনতা গড়ে তুলবে, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশাবাদী তাঁরা…
Powered by Froala Editor