‘আমুল- দ্য টেস্ট অফ ইন্ডিয়া’। শহরে-মফস্বলে দু-চারটে দোকান পরে পরেই এই বিজ্ঞাপন প্রায় সকলেরই মুখস্থ হয়ে গেছে। সকালবেলা চায়ের দুধ থেকে পাঁউরুটিতে মাখিয়ে খাবার মাখন সবকিছুরই একটাই নির্ভরযোগ্য ঠিকানা ‘আমুল’। ভারতের সবথেকে বৃহৎ দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে সবার আগে, একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে ‘আমুল’ নামের এই সংস্থাটি। সংবাদমাধ্যমে, পত্রিকায় ভারতের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় যে লাল ববি প্রিন্টের ফ্রক পরিহিত লালচে বাদামী চুলের কিশোরী মেয়েটিকে বারবার প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে, সে এই আমুলেরই ‘ম্যাসকট’। সব মিলিয়ে ভারতবাসীর জনমানসে বহু বছর ধরেই আমুল যেমন তার ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ বজায় রেখে চলেছে, তেমনই ভারতবাসীর স্বাদও আমূল বদলে দিয়েছে সেই ৫০ বছর আগে থেকে। আর এই ‘আমুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গুজরাটের বিখ্যাত সমাজকর্মী ত্রিভুবনদাস কিশিভাই পটেল। ত্রিভুবনদাস পটেল ছিলেন একজন গান্ধীপন্থী স্বাধীনতা সংগ্রামীও।
গুজরাটের খেদা জেলার আনন্দ-এ ১৯০৩ সালের ২২ অক্টোবর ত্রিভুবনদাস কিশিভাই পটেলের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম শ্রী কিশিভাই পটেল এবং মায়ের নাম শ্রীমতি লখিবা। তাঁরা তিন ভাই ছিলেন – শ্রী ভগবানদাস পটেল, শ্রী চিম্মনভাই পটেল এবং তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কৃষক। ত্রিভুবনদাস পটেলের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়েছিল নানাধ্নি ধর্মশালায়। তারপর তিনি ভর্তি হন আনন্দ প্রাইমারি স্কুল-এ। এছাড়া নিউ ইংলিশ স্কুল থেকে তিনি বাকি পড়াশোনা শেষ করেন। এই স্কুলটি বর্তমানে ডি এন হাই স্কুল অফ কারোটার এডুকেশন সোসাইটি নামে পরিচিত। এরপরে ত্রিভুবনদাস ভর্তি হন আমেদাবাদের গুজরাট বিদ্যাপীঠ-এ স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই তিনি মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন, গ্রামীণ উন্নতি এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আন্দোলনে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯১৮ সালে তিনি মণিলক্ষ্মী মোতিভাই পটেলকে বিবাহ করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত তিনি হরিজন সেবক সমিতি’র সভাপতি ছিলেন। নাসিক-এ ১৯৩০ সালে তিনি প্রথম কারারুদ্ধ হন লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দেবার জন্য। মহাত্মা গান্ধী এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অনুপ্রেরণায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তারপর ১৯৪০ সালের শেষদিকে, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নির্দেশে তিনি খেদা জেলায় কৃষকদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন।
সেসময় পলসন এন্ড পলসন ডেয়ারির একচেটিয়া ব্যবসা ছিল ‘বম্বে মিল্ক স্কিম’। কেন্দ্রীয় সরকার এই সংস্থাকেই দুধ উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু যে কৃষকরা দুধ সংগ্রহ করে আনত, গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিত তাদের ঠিকমতো বেতন দেওয়া হচ্ছিল না। তাই সমস্ত কৃষক ক্ষোভে ত্রিভুবনদাসের কাছে এসে প্রতিবাদ জানায় এই অনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। ত্রিভুবনদাস পটেল মোরারজি দেশাই-এর সহায়তায় সমস্ত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন। তারা সকলে পলসন ডেয়ারির হয়ে কোনোপ্রকার কাজ করতে অস্বীকার করে, বন্ধ চলে। সেই থেকেই ১৯৪৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর ত্রিভুবনদাসের উদ্যোগে তৈরি হয় কায়রা জেলার সমবায় দুগ্ধ উৎপাদক ইউনিয়ন লিমিটেড। ১৯৫৫ সালে এই সংস্থার নাম হয় ‘আমুল’। এই সংস্থার কর্মোদ্যোগের ফলেই আজ ভারত সারা বিশ্বে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে সবার থেকে এগিয়ে। ত্রিভুবনদাসের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ড. ভার্ঘিস কুরিয়েন (Varghese Kurien) এবং ছিলেন মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেয়ারি প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরেক তরুণ দলায়া (Dalaya)। এই ত্রয়ীর উদ্যোগে কায়রা জেলার সমবায় দুগ্ধ প্রকল্প সারা দেশে বিখ্যাত হয়ে পড়ে। সেসময় প্রাকৃতিক কারণেই গরমকালে মোষের দুধ উৎপাদন কম হত, আবার শীতকালে অতিরিক্ত পরিমাণে দুধ উৎপাদন হত। শীতকালে মোষের এরকম অবস্থাকে বলা হয় ‘উইন্টার ফ্লাশ’। ফলে সমস্যা ছিল সারা বছরব্যাপী দুধের যোগান একইরকম রাখা। তাই দলায়া ডেনমার্কে গিয়ে শিখে এসেছিলেন কীভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে শীতকালে উৎপন্ন অতিরিক্ত দুধকে গুঁড়ো দুধে পরিণত করা যায়। এই গুঁড়ো দুধ সংরক্ষণ করে রাখা যায় এবং গরমকালে যখন দুধের ঘাটতি থাকে তখন তা প্রাপ্ত দুধের সঙ্গে মিশিয়ে সরবরাহের পরিমাণে বছরব্যাপী ভারসাম্য রাখা যায়।
ড. কুরিয়েন যোগ দেবার পর এই সমবায়ের খ্যাতি আশেপাশের মেহসানা, বরোদা, সবরকণ্ঠ ইত্যাদি নানা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। পরপর আরো পাঁচটি ডেয়ারি ইউনিয়ন তৈরি হয়। ত্রিভুবনদাস পটেলের নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় এবং ড. ভার্ঘিস কুরিয়েনের সহায়তায় গুজরাটের আনন্দ-এ পরপর শুরু হয় গুজরাট কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন, ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড এবং ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট। ভারতের মধ্যে প্রথম এই ‘আমুল’ই দুধ উৎপাদনে ড্রায়ার-স্প্রেয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল। ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে খেদা ডেয়ারিতে চালু হয়েছিল ‘নিরো অ্যাটোমাইসার’, মোষের দুধকে শুকনো করার জন্য নির্মিত বিশ্বের প্রথম ‘স্প্রেয়ার-ড্রায়ার’।
আর এভাবেই ১৯৭০-এ সারা ভারতব্যাপী ‘শ্বেত বিপ্লব’- ঘটিয়েছিলেন ত্রিভুবনদাস এবং বিশেষত ড. কুরিয়েন। এই বছরই ‘অপারেশন ফ্লাড’ নামে যে প্রজেক্টটি ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড চালু করে, তার ফলে প্রচুর দুগ্ধ উৎপাদক কৃষক, গো-পালনকারী দরিদ্র ভারতীয় আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হন। এই সাফল্যেরই নাম দেওয়া হয় ‘শ্বেত বিপ্লব’। এই প্রেক্ষাপটেই বিখ্যাত পরিচালক শ্যাম বেনেগাল একটি ছবিও তৈরি করেছিলেন। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিজয় তেণ্ডুলকর এবং ড. ভার্ঘিস কুরিয়েন। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া সাড়া জাগানো সেই ছবির নাম ‘মন্থন’। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন গিরিশ কারনাড, কুলভূষণ খারবান্দা, নাসিরুদিন শাহ, স্মিতা পাতিল প্রমুখ। খেদা জেলায় দুগ্ধ সমবায় প্রকল্পের কারিগর ত্রিভুবনদাসের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ। এই ছবিটি অবিশ্বাস্যভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিশেষ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তার দুটি কারণ – প্রথমত মুক্তি পাওয়ার পরের বছরই এই ছবিটি ‘ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’ পায়, ১৯৭৭ সালে। ছবিতে ব্যবহৃত বিখ্যাত গান ‘মেরো নাম কাথাপারে’র জন্য গায়িকা প্রীতি সাগর সেরা মহিলা প্লে-ব্যাক গায়িকা হিসেবে পান ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। এই গানটিই পরে ‘আমুল’-এর বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়। আর দ্বিতীয় কারণ হল, এই ‘মন্থন’ হল ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ মানুষের সঞ্চিত অর্থে নির্মিত ছবি যাকে বলে ‘ক্রাউড ফান্ডিং’।
১৯৬৩ সালে ‘কমিউনিটি লিডারশিপ’-এর জন্য ‘রামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার’ এবং ১৯৬৪-তে ভারত সরকারের থেকে ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘আমুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম চেয়ারম্যান ত্রিভুবনদাস কিশিভাই পটেল। ভারতের প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর এককালীন সভাপতিও ছিলেন তিনি। শুনলে আশ্চর্য হতে হয়, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অনুগামী এই মানুষটি বল্লভভাই প্যাটেলের উপর নির্মীয়মান তথ্যচিত্র ‘সর্দার’-এর জন্য বহু অর্থসাহায্য করেছিলেন। ত্রিভুবনদাসের সমগ্র জীবনে ও কাজে ‘সর্দার’-এর প্রভাব ছিল সুগভীর। ১৯৯৪ সালের ৩ জুন মৃত্যু হলেও ত্রিভুবনদাসের ‘আমুল’ আজও ‘দ্য টেস্ট অফ ইন্ডিয়া’।
আরও পড়ুন
কাজ পাননি বাংলায়, মুম্বাই-এ প্রতিষ্ঠা পেয়েও নিজের শিকড়েই বুঁদ শিল্পী অনিকেত মিত্র
Powered by Froala Editor