জগদীশচন্দ্র বসু কী করেছিলেন? গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন। আর কী করেছিলেন? রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন। মার্কনি নামে এক ইতালির ‘মাফিয়া’ বিজ্ঞানী সেটা চুরি করে নেন। কেন? আসলে জগদীশ আত্মভোলা ছিলেন তো, উনি পেটেন্ট ফেটেন্ট পছন্দ করতেন না। কোনোদিন নিজের আবিষ্কারের পেটেন্ট নেননি। বিদেশের সাহেবরা তাঁকে সম্মান দিল না। বাঙালি বলেই…
এই হল জগদীশচন্দ্র নিয়ে আমাদের আম জনতার মতামত। তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু যখন দেখি এই প্রতিটা ভুল কথা শিশুদের বইতে ঠাঁই পাচ্ছে, তখন ভয় হয় বৈকি! এক এক করে বলি…
১। গাছের প্রাণ আছে এটা জগদীশচন্দ্রের জন্মের বহু আগে বিজ্ঞানীরা বলেছেন। আরিস্টটল থেকে ভারতের অথর্ববেদ অবধি। এই নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। তাহলে জগদীশচন্দ্র করলেন কী? ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র বানালেন। এতে গ্রাফিক্যালি দেখানো গেল যে, প্রাণীর মতো উদ্ভিদও উত্তেজনায় সাড়া দেয়। শুধু দেয় এটা দেখিয়েই ক্ষান্ত হলেন না তিনি। কতটা আঘাতে কতটা সাড়া দেয় ( মানে মানুষ হলে চিমটি কাটা আর মারধোরের সাড়া এক হবে না) সেটাও দেখালেন। ভাবলেই বোঝা যাবে কী অভূতপূর্ব এই আবিষ্কার।
১৬৬৫ সালে রবার্ট হুক নামে এক ভদ্রলোক প্রথম উদ্ভিদ কোষ দেখেন। ১৮৩৮ সালে স্লাইডেন ও সোয়ান কোষের থিওরি দেন। তাতে প্রাণী ও উদ্ভিদ দুই কোষের কথাই আছে। জগদীশচন্দ্র যেটা আবিষ্কার করেছেন, বিজ্ঞানীরা তাঁকে বলেন Plant perception বা সংবেদনশীলতা। প্রাণের সঙ্গে এর বিস্তর তফাত।
২। গোটা রেডিও জগদীশচন্দ্র কোনোদিন আবিষ্কার করেননি। যে যাই বলুক। যেটা করেছিলেন সেটা হল বেতার সংকেত রিসিভ করার জন্য যে রিসিভার ব্যবহার হত, তাকে বলত কোহেরার। অনেক বিজ্ঞানীই এই কোহেরার তৈরির চেষ্টা করেছিলেন আগেই। জগদীশ বোস প্রথম পারদের সাহায্যে সফল ও উন্নত এক কোহেরার তৈরি করেন যা তখনকার দিনে সেরা ছিল। এমনকি তিনি সেটা জার্নালে ‘নিজের নামে’ প্রকাশও করেন।
ঠিক এই জায়গায় জগদীশ ভুলটা করে বসেন। যারা একটুও বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করি, তাঁরা জানি, পেপার পাবলিশ মানেই তোমার তথ্য পাবলিক ডোমেনে সবার জন্য চলে এল। এবার এটা যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। তাই সেটা আটকাতে আগে পেটেন্ট নিয়ে নিতে হয়। পেপারে তখন সব না বলে শুধু পেটেন্ট নম্বরটা দিলেই চলে। এটা জগদীশের ভুল। আর একবার জার্নালে বেরোতেই মার্কনি নড়েচড়ে বসলেন। তিনিও একই ধরনের কাজ করছিলেন। আটকাচ্ছিল একটা জায়গাতেই। ভাল রিসিভার পাচ্ছিলেন না। বোসের পেপার পড়ে তিনি সেই পদ্ধতিতে মার্কারি কোহেরার বানালেন আর তা দিয়ে আটলান্টিকের এপার থেকে ওপারে বেতার তরঙ্গ পাঠালেন। মার্কনির রেডিওতে যা যা অংশগুলি ছিল সেগুলো হল, এন্টেনা, ট্রান্সমিটার, ডায়োড, টারনিং কয়েল, এমপ্লিফায়ার আর রিসিভার। এতগুলো জিনিসের সঠিক টিউনিং-এ রেডিও হয়।
যেটা আমার বক্তব্য, জগদীশচন্দ্র কোনোদিন সম্পূর্ণ বেতারযন্ত্র বানাননি। বানিয়েছিলেন বেতারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এর কৃতিত্ব অবশ্যই তাঁকে দেওয়া উচিত ছিল। এটা মার্কনি দেননি। খারাপ করেছেন। কিন্তু মার্কনি কিছুই করেননি। গোটাটা জগদীশচন্দ্রের কাজ চুরি বললে মার্কনির প্রতি অবিচার করা হয়।
৩। কথায় বলে ঘা খেয়ে শেখা। ১৯০৪ সালে জগদীশচন্দ্র যখন আবার একটি সলিড স্টেট ডায়োড ডিটেকটার বানালেন তখন পেপার পাবলিশের আগেই তিনি তাঁর পেটেন্ট নিয়েছিলেন নিজের নামে। ফলে এর গোটা কৃতিত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। গ্যালিনার কেলাস দিয়ে এটি তৈরি করেন তিনি।
৪। এবার আসি বাঙালির হাহাকারে। ‘কেউ তাঁকে চিনল না’-তে। আসলে বাঙালিই তাঁকে চেনেনি। চিনলে জানত সমসাময়িক লর্ড কেলভিন মুক্তকণ্ঠে বলেছিলেন “You are literally filled with wonder and admiration: allow me to ask you to accept my congratulations for so much success in the difficult and novel experimental problems which you have attacked." সেই ১৮৯৭-তে বেতারের কোহেরার আবিষ্কার নিয়ে ফরাসি আকাদেমি অফ সায়েন্স জানায় "the very first result of your researches testify to your power of furthering the progress of science. For my own part, I hope to take full advantage of the perfection to which you have brought your apparatus, for the benefit of Ecole Polytechnique and for the sake of furhter researches I wish to complete"
জগদীশচন্দ্র বসু এক বিরল প্রতিভা। নিজ গুণেই ভাস্বর। তাঁকে চিনতে গেলে তাঁর কাজেই তাঁকে মহান করা যায়। অন্যকে চোর অপবাদ না দিলেও চলে…
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)