অরণ্যে পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে ‘গাছের চোখ’

কথায় আছে, দেওয়ালেরও কান আছে। আর গাছের চোখ? না, গাছ মানুষের মতো দেখতে পায় না ঠিকই। তবে ‘গাছের চোখ’ অরণ্যের মধ্যে পথ দেখাতে পারে মানুষকে। দিতে পারে আলোর সন্ধান। সম্প্রতি ‘দ্য এক্সপেরিমেন্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হাউ টু রিড আ ট্রি: ক্লুস অ্যান্ড প্যাটার্ন ফ্রম বার্ক টু লিভস’-শীর্ষক প্রবন্ধে এমনটাই দাবি করলেন স্ট্র্যাটফোর্ডের গবেষক ট্রিসটান গুলি।

‘ট্রি আইস’ (Tree Eyes)। কথাটার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘গাছের চোখ’। গাছের কাণ্ড থেকে মোটা কোনো ডাল খসে পড়লে সেই জায়গায় তৈরি হয় গোল একটি দাগ। এই দাগগুলিকেই কথ্য ভাষায় বলা হয় ‘ট্রি আই’ বা ‘আই অফ দ্য ট্রি’। গহীন অরণ্যে যে-কোনো মহীরূহের গায়েই দেখা যায় এ-ধরনের দাগ। তবে এখন যদি বলা যায়, কোনো মানুষ বা বাহ্যিক পরিস্থিতির কারণে ভেঙে পড়েনি এই ডাল। বরং, গাছ স্বয়ং এই ডাল ছেঁটে ফেলে তার কাণ্ড থেকে? 

শুনে খানিকটা অবাক লাগারই কথা। তবে শুধু ট্রিসটান নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হওয়া একাধিক গবেষণা বলছে, এমনটাই হয় আদতে। আসলে খাদ্য উৎপাদনের জন্য শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে গাছ। প্রতিটি পাতা, ফুল যাতে আলোর সংস্পর্শে আসতে পারে— সে-জন্যই ডাল বিস্তার করে গাছ। তবে ধীরে ধীরে মহীরূহের উচ্চতা বাড়তে থাকলে বেশি উচ্চতাতেও শাখা জন্মায় গাছের। আর তার ছত্রছায়ায় চলে আসে নিচের শাখাগুলি। সরাসরি আর আলোর সংস্পর্শে আসে না তারা। ফলে ব্যাহত হয় সংশ্লিষ্ট ডালপালায় খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়তি, অপ্রয়োজনীয় ডালগুলিতে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয় গাছ। বন্ধ হয়ে যায় অভ্যন্তরীণ সংবহনতন্ত্র। শুকিয়ে ওঠে শাখাটি। তারপর একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তা খসে পড়ে গাছের মূল কাণ্ড থেকে। সংশ্লিষ্ট ক্ষতস্থান দিয়ে যাতে কোনো ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া বা অন্যকোনো প্যাথোজেন ঢুকে পড়তে না পারে গাছের শরীরে, তার জন্য সেই ক্ষতস্থান গাছ ভরাট করে ফেলে রজন দিয়ে। কালক্রমে সেগুলিই দাগ হয়ে রয়ে যায় গাছের শরীরে। কথ্য ভাষায় এগুলিই পরিচিত গাছের চোখ নামে। গাছের বয়স তো বটেই, গাছের এই চোখ দেখে ঘন অরণ্যে রাস্তা খুঁজে পাওয়াও সম্ভব বলেই দাবি করছেন ট্রিসটান। কীভাবে? 

বছর খানেক আগের কথা। স্ট্র্যাটফোর্ডের পার্বত্য অরণ্যে ট্রেকিং করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সে-সময়ই নজরে আসে বিষয়টি। ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে ওঠার সময় প্রায় প্রতিটি গাছের গায়েতেই এধরনের চোখের উপস্থিতি নজর কেড়েছিল তাঁর। তবে তখনও পর্যন্ত বিষয়টা অস্বাভাবিক লাগেনি কিছুই। তবে পাহাড়ে নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে বুঝতে পারেন, পার্বত্য এই মহীরূহগুলির কাণ্ডের কেবলমাত্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকের অবস্থিত অধিকাংশ চোখ। অন্যদিকে উত্তরমুখী চোখ প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ কী এই আশ্চর্য ঘটনার?

আরও কয়েক মাইল পথ চলার পর বিষয়টা পরিষ্কার হয় ট্রিসটানের কাছে। আসলে পর্বতের ঢাল ক্রমশ বাড়তে থাকায়, অন্য গাছে ও পাহাড়ের ছত্রছায়ায় চলে আসায় দক্ষিণ দিকের শাখাগুলি সূর্যের আলো পায় না পর্যাপ্তভাবে। আর সেই কারণেই ক্রমাগত দক্ষিণমুখী ডালগুলিকে খসিয়ে ফেলে গাছ। ট্রিসটানের কথায়, এর ঠিক উল্টো ঘটনা দেখা যায় পর্বতের অন্যপ্রান্তে। সেখানকার গাছে আবার দেখা যায় উত্তরমুখী চোখ। কারণ পর্বতের ঢাল সেখানে উত্তরমুখী হওয়ায় পর্যাপ্ত আলো পায় না উত্তরদিকের শাখাগুলি। 

ট্রিসটানের কথায়, ঘন অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলা মানুষকে আলোর সন্ধান দিতে পারে এই প্রাকৃতিক চিহ্নগুলি। পর্বতের ঢাল কোনদিকে কিংবা পাহাড়ের মধ্যে কোথায় শুষ্ক অঞ্চল রয়েছে— তা অনায়াসেই চিহ্নিত করা যায় গাছের চোখের মাধ্যমে। 

ফি-বছর পাহাড়ে ট্রেকিং করতে যান অথবা ক্যাম্পিং ভালোবাসেন— এমন মানুষের অভাব নেই এই বাংলায়। এই তালিকায় পড়লে, মাঝেমধ্যে গাছের সাহায্যে পথ চিনে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন আপনিও। থাকুক না ম্যাপ, কম্পাস কিংবা চেনা রাস্তা, একটু না-হয় পরীক্ষামূলকভাবেই গাছের চোখে চোখ রেখেই দেখলেন কোন পথে হাঁটতে বলছে তারা…

Powered by Froala Editor